গোলাগুলি থেমেছে মিয়ানমারের রাখাইনে। গতকাল সারাদিন বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম থেকে টেকনাফের সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি ও মর্টারশেলের শব্দ শোনা যায়নি। এতে দিনটি স্বস্তিতে পার করেছেন সীমান্তের এপারের মানুষ।
এ ছাড়া ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তেও ১১ দিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি ও মর্টারশেলের শব্দ শোনা যায়নি। পরিস্থিতি শান্ত থাকায় স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরেছেন সীমান্তের মানুষ। এদিকে গত চার দনে জান্তা বাহিনীর আরও ঘাঁটি দখল করেছে মিয়ানমারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস-পিডিএফ ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) বিদ্রোহীরা।
অন্যদিকে গোলাগুলি বন্ধ হলেও টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ জেটিতে এখনো জনসাধারণের ওঠানামায় বাধা রয়েছে। এ কারণে সেন্টমার্টিনগামী পর্যটক ও সাধারণ লোকজন জেটিতে উঠতে পারেননি। কিছু মানুষের রুটিরুজি নাফ নদের জেটিনির্ভর হওয়ায় সীমান্তের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তারা জেটি উন্মুক্ত রাখার দাবি করেছেন। জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্তে ১১ দিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি ও মর্টারের শব্দ শোনা যায়নি। কিন্তু এর আগের তিন সপ্তাহ সীমান্তের ওপারে মর্টারশেল ও গোলাগুলির বিকট শব্দে ভয়াবহ অবস্থায় কেটেছে সীমান্তবাসীর। ঘরবাড়ি ছেড়ে তাদের অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়েছে। এ ছাড়া ঘুমধুম জলপাইতলীতে মর্টারশেলে দুজনের মৃত্যু এবং তুমব্রুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় সেখানকার কৃষক, শ্রমিকরা তাদের কর্মে ফিরেছেন।
তুমব্রু এলাকার কৃষক মো. আব্দুল হামিদ বলেন, তুমব্রুর দশখানিতে ধানক্ষেত রয়েছে। দুই সপ্তাহ আগেও গোলাগুলি ও মর্টারের শব্দে ভয়ে কাজ না করে বাড়ি ফিরতে হতো। তবে কয়েকদিন ধরে গোলাগুলি না থাকায় ক্ষেতে কাজ করতে পারছি। এদিকে গত সপ্তাহে কক্সবাজারের উখিয়ার রহমতের বিল ও টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে গোলাগুলি বন্ধ থাকায় সেখানকার মানুষও স্বস্তিতে রয়েছেন। নাফ নদের এ দুই সীমান্তে কয়েক হাজার একর জমিতে লবণ চাষ, চিংড়ি ঘের ও শীতকালীন সবজিক্ষেত রয়েছে। রাখাইনে অস্থিরতার সময় চাষিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ছিলেন। তারা এখন ক্ষতি পোষাতে দিন-রাত মাঠে কাজ করছেন।
হোয়াইক্যং এলাকার লবণচাষি মো. সালাম বলেন, মিয়ানমারে গোলাগুলির জন্য ৪০ একর লবণ চাষ ব্যাহত হয়েছে। শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হয়েছে। বর্তমানে সীমান্ত শান্ত থাকায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দিন-রাত কাজ করছি।
দক্ষিণের শেষ সীমান্ত জনপদ শাহ পরীর দ্বীপ ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি শেষ তিনদিন। গত রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির বিকট শব্দ ছিল। সীমান্ত পরিস্থিতিতে নাফ নদে নৌযান চলাচল অনিরাপদ হয়ে পড়ায় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। তবে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সীমান্ত নিরাপদ বলতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
শাহ পরীর দ্বীপ এলাকার জেলে নুরুল ইসলাম বলেন, গত সপ্তাহের শেষ দিকে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি ও বোমা হামলা হয়েছিল। বোমা বিস্ফোরণে এপারে আমাদের ঘরবাড়িও কেঁপেছে। তিন দিন ধরে আপাতত সীমান্ত শান্ত। এখন নাফ নদে নিরাপদে মাছ ধরতে পারব।
এ বিষয়ে টেকনাফের ইউএনও কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের ওপারে গত তিন দিন তেমন গোলাগুলি শোনা যায়নি। অনেকটা স্বাভাবিকতা বিরাজ করছে। নিরাপত্তার স্বার্থে সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন থাকলে পুনরায় নাফ নদ হয়ে সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলবে।
এদিকে মিয়ানমারজুড়ে বিদ্রোহীরা অব্যাহতভাবে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন, কাচিন ও মন প্রদেশ এবং সাগাইং ও বাগো অঞ্চলে জান্তা বাহিনী এসব ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারায় বলে জানা গেছে। পিডিএফ ও ইএওর বিদ্রোহীদের তরফে এসব খবর জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম ইরাবতী। তবে তারা নিরপেক্ষভাবে হতাহত ও ঘাঁটি দখলের এসব খবর যাচাই করতে পারেনি।
আরাকান আর্মি-(এএ) বলেছে, তিন দিন লড়াইয়ের পর তারা কাচিন প্রদেশের মান্দালয়-মিতকিনিয়া সড়কে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি সেনাঘাঁটি দখল করেছে। কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মি-কেআইএ ও কাচিন রিজিওনাল পিপলস ডিফেন্স ফোর্স-কেআরপিডিএফের বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে অভিযান চালিয়ে মানসি শহরের শিখাঙ্গি এলাকার ঘাঁটি দখল করেছে তারা। ঘাঁটি রক্ষায় জান্তা বাহিনীর অন্তত ৬ বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ১৫ জনের বেশি আহত হন।
রাখাইনে আরেক ঘাঁটি দখল : এএর দাবি, গত সোমবার রাখাইনের মংডুর পায় ইউন তাং এলাকার ঘাঁটি দখল করেছে। সেখানে জান্তা বাহিনীর ১০ সদস্যের মরদেহ পাওয়া গেছে। সামরিক জান্তা সিত্তেউই, পোনাকিউন, রাথেডং, রাম্রি, কিয়াউকপিউ ও অ্যান শহরের বেসামরিক এলাকায় আকাশ থেকে হামলা চালাচ্ছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
ইয়ে গেরিলা ফোর্স-ওয়াইজিএফ জানায়, গত সোমবার মন প্রদেশের ইয়ে শহরের মিলিটারি অপারেশন কমান্ড সেন্টার ১৯-এর সদর দপ্তরের সেনা কর্মকর্তাদের আবাসিক এলাকায় ড্রোন হামলা চালিয়েছে তারা। এতে হতাহতের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। দ্য এরিয়া ৭১-কে পিডিএফ জানায়, গত সোমবার সাগাইং অঞ্চলের মনিওয়া শহরে মনিওয়া-চাউং-ইউ সড়কের একটি সেনাঘাঁটিতে বোমা হামলা চালিয়েছে তারাসহ আরেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এতে জান্তা বাহিনীর সদস্যদের হতাহতের বিষয়ে জানা যায়নি।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :