চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা অন্তর্বাস বা গেঞ্জির ভেতরে লুকিয়ে রাখা অত্যাধুনিক ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর পৌঁছে দিত চক্রটি। এতে পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই সব প্রশ্নের উত্তর শেষ করতেন পরীক্ষার্থীরা।
১২ মে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ।
তিনি বলেন, রেলওয়েতে নিয়োগ, প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
গ্রেফতাররা হলো- মো. জুয়েল খান (৪০), মো. রাসেল (৩০), মো. মাহমুদুল হাসান শাকিল (৩৯), মো. আব্দুর রহমান (৩৮), মো. আরিফুল ইসলাম (৩৫), মো. আজহারুল ইসলাম (২৯) ও মো. মাসুম হাওলাদার (২৫)। এসময় তাদের কাছ থেকে বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত জিএসএম সুবিধা সম্বলিত ১০টি অত্যাধুনিক ডিজিটাল ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইস, ৭টি মোবাইল ফোন ও ১০টি সিম কার্ড এবং ১টি পকেট রাউটার উদ্ধার করা হয় বলে জানান ডিবিপ্রধান।
ডিবি প্রধান জানান, বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অত্যাধুনিক ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে উত্তর সাপ্লাই করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্রটি।
তিনি জানান, চক্রটি পরীক্ষা শুরুর ১ থেকে ২ মিনিট আগে কেন্দ্রের কাউকে ম্যানেজ করে প্রশ্নের ফটোকপি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দিত। তাদের প্রশ্নপত্র সমাধান টিম পাঁচ মিনিটের মধ্যে তা সমাধান করে ফেলতো। এরপর তারা উত্তরগুলো ডিভাইস সরবরাহকারীদের বলতে থাকতো। যা পরীক্ষার্থীরা ১০ মিনিটের মধ্যে সলভ করে ফেলতো।
ডিবিপ্রধান বলেন, চক্রটি বাইরে থেকে উত্তর বলবে আর যাদের অন্তর্বাস বা গেঞ্জির সঙ্গে ডিভাইস লাগানো তারা ভেতর থেকে উত্তরগুলো শুনে সঙ্গে সঙ্গে এমসিকিউ দাগিয়ে ফেলবে। দিন দিন এভাবে ক্রাইমের প্যাটার্ন চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। এক সময় আমরা নকল প্রতিরোধের জন্য কাজ করেছি। সে সময় তারা পরীক্ষার হলে বই নিয়ে যেত। অপরাধীরা তাদের অপরাধের প্যাটার্ন (ধরন) চেঞ্জ করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে ধরার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করছে। সর্বশেষ আমরা যেটা পেলাম ডিভাইস, এটা এমন জায়গায় রাখছে যেখানে ধরার বা চেক করার কোন স্কোপ নেই।
গ্রেফতারদের স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, আসামিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের হোয়্যাটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারের বার্তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চক্রের সদস্যরা প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ (তৃতীয় ধাপ), বাংলাদেশ রেলওয়ের টিকেট কালেক্টর (গ্রেড ২) ও বুকিং অ্যাসিসটেন্ট (গ্রেড ২), পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অফিস সহায়ক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, টাঙ্গাইলের অফিস সহায়ক, মৎস্য বিভাগের অফিস সাহায়ক, গণপূর্তের হিসাব সহকারী ও অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের অফিস সহায়ক, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সহকারী ব্যবস্থাপকসহ আরও বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় উল্লিখিত পন্থায় অপরাধ কর্ম সংগঠিত করেছে।
তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃত আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে দীর্ঘদিন যাবৎ চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই কাজ করে আসছে। চাকরি ভেদে এমসিকিউ পরীক্ষায় টিকিয়ে দেওয়ার জন্য ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা এবং লিখিত ও ভাইভাসহ ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা পরীক্ষার্থীদের নিকট থেকে নিতো।
চক্রের মূল হোতা জুয়েল খান (৪০) বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত জিএসএম সুবিধা সম্বলিত ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইস সংগ্রহ ও সরবরাহ, প্রশ্নপত্র সংগ্রহ, সমাধান টিমের সদস্য সংগ্রহ ও চক্রের অন্যান্যদের সাথে সমন্বয় করতো। মো. রাসেল (৩০) ও মো. মাহমুদুল হাসান শাকিল এবং মো. আব্দুর রহমান (৩৮) বিভিন্ন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ এবং পরীক্ষার্থীদের কাছে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইস পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি ডিভাইসটি কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তার বিস্তারিত ব্যবহার বিধি শিখিয়ে দিত। মো. আরিফুল ইসলাম (৩৫) পরীক্ষা কেন্দ্রের অভ্যন্তর হতে পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর সুবিধামতো সময়ে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান করা চক্রের অন্য সদস্যদের কাছে পৌঁছে দিত। এরপর তাদের সমাধান টিম অতিদ্রুত সেই প্রশ্নপত্র সমাধান করে কেন্দ্রের অভ্যন্তরে তাদের নির্ধারিত পরীক্ষার্থীদের কাছে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইসের মাধ্যমে প্রেরণ করতো।
বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত জিএসএম সুবিধা সম্বলিত এই ডিজিটাল ইলেকট্রনিক স্পাই ডিভাইসটি মেয়েদের `অন্তর্বাস` ও ছেলেদের গেঞ্জি`র ভিতরে এমনভাবে সেলাই করে সংযুক্ত করা থাকে যা বাহির থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকে না।
ডিভাইসে একটি মোবাইল সিম কার্ড সংযুক্ত থাকে। কেন্দ্রের বাহির থেকে ওই নম্বরে কল করা মাত্রই সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিসিভ হয়ে যায়। এই ডিভাইসের সাথে ব্লুটুথ-এর মাধ্যমে কানেক্ট থাকা `ছোট্ট বল আকৃতির রিসিভার স্পিকারটি পরীক্ষার্থীদের কানের ভিতরে থাকে ফলে বাহির থেকে উত্তর বলে দিলে নির্দিষ্ট পরীক্ষার্থীরা অনায়াসে তা লিখতে পারে। পরীক্ষা শেষে শক্তিশালী কলম সদৃশ চুম্বকের (ডিভাইসের বিশেষ অংশ) সহায়তায় সেটি কানের ভিতর থেকে বের করা হয়।
একুশে সংবাদ/ বা.২৪/ এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :