গত ২৮ বছরে তিনবার ভয়াবহ আগুনের কবলে পড়ে রাজধানী গুলিস্তানের বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স। প্রতিবারই আগুন লাগার পর একই স্থানে ঝুঁকি নিয়ে চলছিল ব্যবসা। বঙ্গবাজারে ব্যবসায়ীদের কোনভাবেই এতদিন ঝুঁকিমুক্ত স্থাপনায় সরানো যায়নি। সর্বশেষ গত বছরের আগুনে ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বারবার আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরও ঝুঁকি নিরসনে কোন উদ্যোগ নেয়নি বঙ্গবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এখন সেখানে ১০ তলা পাকা মার্কেট তৈরি করতে যাচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৯৬১ জন ব্যবসায়ীর সবাইকে বঙ্গবাজার নগর পাইকারি বিপণীবিতানে পুনর্বাসন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবাজারে ১৯৯৫ সালের পর সর্বশেষ বড় ধরনের আগুন লাগে ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বঙ্গবাজারের গুলিস্তান ইউনিটের সেই আগুনে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। তবে গতবছরের ৪ এপ্রিলের মতো সবটা শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৯৫ সালের আগুনে পুড়েছিল ৫২৫টি দোকান। আর এইবার পুড়েছে ২ হাজার ৩৭০টি দোকান। ২০১৮ সালের সেই আগুনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বারবার সতর্ক করার পরও বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক কমিটির নির্দেশনা মানেনি।
বিপণীবিতানটির অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও কোথাও ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা (স্মোক ও হিট ডিটেক্টর), ফায়ার হোজরিল, পাম্প, ফায়ার অ্যালার্ম বা অন্য কোনো অগ্নিনির্বাপণ–ব্যবস্থা ছিল না।
গত বছর বঙ্গবাজারে আগুনে প্রায় ২৮৮ কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)-এর তদন্ত কমিটি। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগুনে মোট ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা ১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বলে দাবি করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, বঙ্গবাজারে লাগা আগুনে একেবারে পথে বসেছেন তারা। তাদের বেশিরভাগই ব্যাংক ঋণে জর্জরিত। অনেকে বিভিন্ন ধরনের সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছিলেন। বঙ্গবাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আগুনে সব হারিয়ে এখন তার কাঁধে ঋণের বোঝা। ঋণের বোঝা থেকে কীভাবে মুক্তি পাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
গত বছর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগার পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন করার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবাজার মার্কেটে ১৯৯৫ সালে একবার আগুন লাগে। এরপর আবার ২০১৮ সালে আগুন লাগে। তারপর আমরা এখানে সুপরিকল্পিত মার্কেট করার প্রকল্প গ্রহণ করি। তখন বেশ কিছু লোক বাধা দেয়। শুধু বাধা নয়, একটা রিটও করে। পরে হাইকোর্ট এটাকে স্থগিত করে দেয়।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বলছে, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সকে তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল। এ ব্যাপারে তারা ১০ বার নোটিশও দেয়। অন্যদিকে ডিএসসিসি বলছে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে তারা আগেই নতুন বহুতল ভবন করতে চেয়েছিল। কিন্তু দোকানমালিকদের বাধায় তা হয়নি। গত বছরের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে ১০ তলা বিপণিবিতান নির্মাণের নতুন পরিকল্পনা নেয় ডিএসসিসি।
শনিবার (২৫ মে) বঙ্গবাজার নগর পাইকারি বিপণী বিতান নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, বঙ্গবাজারে ১০৬ কাঠা জমির ওপর নতুন বিপণিবিতানটি নির্মাণ করতে অন্তত চার বছর সময় লাগবে। বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেট, গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, মহানগর হকার্স মার্কেট ও আদর্শ হকার্স মার্কেট—এই চার মার্কেট নিয়ে গঠিত হবে নতুন বিপণীবিতান।
ডিএসসিসির হিসাবে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেটে ২ হাজার ৯৬১টি বৈধ দোকান ছিল। এসব দোকানমালিকেরা বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনের তহবিলে দুই লাখ টাকা করে জমা দিয়ে বরাদ্দ পেয়েছিলেন। বৈধ বরাদ্দপত্র ও প্রয়োজনীয় নথি দেখাতে এই মালিকদের সবাই নতুন বিপণীবিতানে দোকান পাবেন বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির কর্মকর্তারা।
নতুন বিপণীবিতানে দোকানসংখ্যা হবে ৩ হাজার ২১৫টি। অর্থাৎ বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের তুলনায় নতুন বিপণিবিতানে অতিরিক্ত ২৪৬টি দোকান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, পুড়ে যাওয়া মার্কেটে দোকানের আকার ছিল সর্বনিম্ন ১৭ বর্গফুট, সর্বোচ্চ ২২ বর্গফুট। নতুন বিপণিবিতানে দোকানের আকার হবে ৮০ থেকে ১২০ বর্গফুট। দোকানের আকার বড় হওয়ার কারণে আগের মালিকদের দোকানপ্রতি গড়ে ২০ লাখ টাকার মতো সিটি করপোরেশনের তহবিলে জমা দিতে হবে।
পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের এক দোকানমালিক আবদুল গনি গাজী বলেন, নতুন বিপণীবিতান নির্মাণের কাজ শুরু হবে। সেখানে দোকান বুঝে পাওয়ার নিশ্চয়তা পেলে ২০ লাখ টাকা করে দিতে কেউ আপত্তি করবেন না।
১০তলা বিশিষ্ট বঙ্গবাজার নগর পাইকারি বিপণিবিতানে পাঁচটি সাধারণ সিঁড়ি ও ছয়টি অগ্নি প্রস্থান সিঁড়িসহ পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিপণীবিতানের প্রতিটি ব্লকের জন্য আলাদা বাহির ও প্রবেশদ্বার থাকবে। ভবনে বৈদ্যুতিক যান্ত্রিক কক্ষ এবং প্রতিটি ব্লকের প্রতি তলায় চারটি করে শৌচাগার থাকবে। এ ছাড়া ভবনের বেইজমেন্টে ১৬৯টি গাড়ি ও ১০৯টি মোটরসাইকেল পার্কিংয়ের সুবিধা থাকবে। ৩৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়েছে ডিএসসিসি।
বঙ্গবাজার প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপস বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স পুড়ে গিয়েছিল। আমরা সেখানে নতুন বিপণীবিতান নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। বিগত ৪ বছরে বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতানসহ ৬টি বিপণীবিতান নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়েছে এবং নতুন ৩টি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২টি বিপণীবিতানের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয়েছে, ৩টি ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে এবং ৪টির ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ জরিপে উঠে এসেছে, ঢাকাসহ দেশের আট বিভাগে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৩৭৬ বহুতল, শিল্পকারখানা, মার্কেট-শপিংমল, সরকারি ও অন্যান্য ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে অতি অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবনের সংখ্যা পাওয়া গেছে ৪২৪টি, আর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ১ হাজার ৬৯৪টি।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় আছে কাওরানবাজারের কাঁচা বাজার সংলগ্ন ভবন। সেটিও ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর কাওরানবাজার থেকে কাঁচা বাজার স্থানান্তরের কার্যক্রম শুরু করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ডিএনসিসি। ঝূঁকিপূর্ণ ভবন থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় সরানোর মধ্য দিয়ে ঢাকার কারওয়ান বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে গত ২৮ মার্চ।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘কারওয়ান বাজারে ডিএনসিসির পরিত্যক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা হবে। কারওয়ান বাজারের এই কাঁচাবাজারের ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় এটি ধসে পড়তে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণে বহু মানুষের জীবন হুমকিতে রয়েছে। কারওয়ান বাজারস্থ পাইকারি কাঁচাবাজারের এই ব্যবসায়ীদের গাবতলিতে ডিএনসিসির পাইকারি কাঁচাবাজারে স্থানান্তর করা হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের দেওয়া তথ্য মতে, গাবতলীতে যে কাঁচাবাজারটি রয়েছে সেটি পরিকল্পিতভাবে সব কমপ্লায়েন্স মেইনটেইন করে নির্মাণ করা হয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করে এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে এখানে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ। এখানে চারটি বহির্গমন পথ রয়েছে। ট্রাক থেকে মালামাল আনলোড করার যথেষ্ট ব্যবস্থা রাখা আছে। ব্যবসায়ীদের জন্য বিশ্রামাগারও করা হয়েছে। এখানে নদীপথেও মালামাল পরিবহন করা যাবে। মার্কেটের পাশ দিয়ে আট লেনের সড়ক হচ্ছে। মার্কেট থেকে মেইন রোডের সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে।
কাওরান বাজারসহ কয়েকটি মার্কেটের অবস্থা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নত স্মার্ট মার্কেট প্রয়োজন। কোনও ধরনের জরাজীর্ণ মার্কেট বাংলাদেশে থাকতে পারে না। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো ভেঙে আধুনিক মার্কেট নির্মাণ করে দেবো। নতুন মার্কেট ভবন নির্মাণ মানে বরাদ্দপ্রাপ্ত দোকানিদের দোকান নিয়ে নেওয়া না, বরং সুন্দর দোকান পাবেন।’
অন্যদিকে বেইলি রোডে গ্রিন কজি কটেজে আগুনের পর রাজধানীর সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে একটি নীতিমালা তৈরি এবং এতে বুয়েটসহ বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে তৃতীয় পক্ষ যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর যত ভবন আছে, সব পরীক্ষা করা হবে। কোনো ভবন ভেঙে ফেলা হবে কিনা সেটি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর আলোকে অবৈধ ভবন বৈধকরণ পদ্ধতিও চূড়ান্ত করা হবে।
রাজউকের কমিটি প্রস্তাব করেছে, নির্ধারিত ফির ৫ গুণ জরিমানা দিয়ে অবৈধ ভবন বৈধকরণ করা হবে। ঝুঁকি যাচাই-বাছাই কমিটিতে রাখা হবে সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞদের। সেখানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) প্রতিনিধি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) প্রতিনিধি, রাজউকের টেকনিক্যাল প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে হবে তৃতীয় পক্ষ।
জাতীয় নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, নীতিমালা হলে ঢাকা শহরের অবৈধ ভবনগুলো একটা কাঠামোতে চলে আসবে। অবৈধ ভবনের বিরুদ্ধে রাজউকের অভিযানের জন্য একটা গাইড লাইন তৈরি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অভিযানে যাওয়ার পর ভবনটি কীসের ভিত্তিতে অবৈধ বা ঝুঁকিপূর্ণ, অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যত্যয় চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো লিখিত থাকতে হবে। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করাই হবে আমার প্রথম কাজ। একই সঙ্গে পরিবেশের দিকটি মাথায় রেখে পুরান ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি রাজধানীকে গড়ে তুলতে চাই আরও আধুনিক ও পরিকল্পিতভাবে।
একুশে সংবাদ/স.ল.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :