সোমবার ২৭ মে সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবচিহ্ন। ঘরবাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে বিধ্বস্ত অবস্থা। কোথাও কোথাও গাছপালা উপড়ে বন্ধ হয়ে গেছে যোগাযোগব্যবস্থা। বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অনেক এলাকা। ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে জলোচ্ছ্বাসে।
একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়ছে উপকূলে। ভেসে গেছে হাজার হাজার চিংড়ি ঘের। এমন চিত্র দেখা গেছে উপকূলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে।
ঘূর্ণিঝড়ের আগেই প্রাণে বাঁচাতে দেশের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে স্থান নেয় ১০ লাখের বেশি মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানান, মানুষজন আগেভাগেই আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও জলোচ্ছ্বাসে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া, নদী ও সাগরের পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। বাতাসের গতিবেগ ওঠে ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটারে।
স্থানীয়রা জানান, দুর্বল বাঁধে কারণে ঘূর্ণিঝড় শুরু আগেই ভেঙে যায় অধিকাংশ বেড়িবাঁধ। এতে সুরক্ষার প্রথমপর্যায়েই ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ভেসে গেছে মাছের ঘের। ঘূর্ণিঝড় রেমালে সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও ভোলা ও চট্টগ্রামে ৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া, মোংলায় ট্রলার ডুবে নিখোঁজ রয়েছে আরও দুইজন।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে নির্মাণাধীন ৪ তলা ভবনের দেয়াল ধসে বরিশালে ২ জন নিহত হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও একজন। আহতকে প্রথমে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ জানায়, ভোরে সাড়ে ৪টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। শহরের রুপাতলি ফিলিং স্টেশন এলাকায় চারতলা বিশিষ্ট একটি নির্মাণাধীন ভবনের ৪র্থ তলার দেয়াল ধসে পড়ে পাশে টিনশেড একটি দোকানে। এসময় দোকান মালিক লোকমান, মোকসেদ নিহত হন। গুরুতর আহত হন বাবুর্চি সাকিব।
ঝড়ে সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দ্বিতীয় দিনের মতো বিদ্যুৎ বিছিন্ন রয়েছে ভোলা জেলা। নৌযান চলাচল বন্ধ থাকায় যোগাযোগ বিছিন্ন রয়েছে। স্থানীয় হজারিয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সেলিম বেপারী জানান, ভোর ৪টার দিকে মনেজা খাতুনের বসত ঘরের উপর একটি গাছ উপড়ে পড়ে। এতে ওই ঘরচাপা পড়ে তিনি মারা যান। তবে তার সাথে থাকা শিশুটি বেঁচে গেছে। তার স্বামীর নাম আবদুল কাদের।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ঘটনাটি শুনেছি তবে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে যোগাযোগ করতে পারছিন না। এছাড়াও দৌলতখান পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের ভুঁইয়া বাড়িতে ঘরচাপা পড়ে মাইশা নামের ৩ বছরের এক শিশু মারা গেছে। আহত হয়েছে তার বাবা, মা, বোনসহ ৪ জন। এদিকে জেলার বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রোববার দিবাগত রাত ৯টা থেকে বরগুনায় তাণ্ডব শুরু করে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। এরপর টানা ১১ ঘণ্টা ধরে চলছে রেমালের তাণ্ডব। সোমবার সকাল সোয়া আটটার দিকে এ রিপোর্ট লেখার সময় তীব্র ঝড়ো হাওয়া বইছে জেলার উপর দিয়ে। টানা বৃষ্টিপাত ও জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ২০টি গ্রাম।
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিভিন্ন স্থানে গাছ পড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি বসত ঘরের উপর গাছ পড়েছে। রাতে জলোচ্ছ্বাসে পানিতে তলিয়ে গেছে জেলার নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মাছের ঘের।
সদর উপজেলার বড়ইতলা এলাকার লতিফ মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, এতো দীর্ঘ সময় ধরে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব এর আগে আর কখনও দেখিনি। প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে বরগুনায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল তাণ্ডব চালাচ্ছে। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
পোটকাখলী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া রব মিয়া বলেন, রাত আটটার দিকে ঘূর্ণিঝড় হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। এখনও ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব কমেনি। তাই আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছি। বাড়িঘরে কী অবস্থা এখনও খোঁজ নিতে পারিনি।
লতাবাড়িয়া গ্রামে বাসিন্দা শাহ আলম বলেন, রাতে জলোচ্ছ্বাসে আমাদের এখানের বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় ৬০টি বাড়ি প্লাবিত হয়েছে। ঘরের সকল মালামাল পানিতে তলিয়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে নোয়াখালীতে প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস ও ভারি বর্ষণ হচ্ছে। উত্তাল মেঘনায় উপকূলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৫০ হাজার মানুষ।
রোববার দুপুর থেকে মেঘনা নদীতে পানির উচ্চতা বাড়ার কারণে হাতিয়ার হরণি, চানন্দি, নলচিরা, সুখচর, চরঈশ্বর, সোনাদিয়া, চরকিংসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ড ও মেঘনার তীরবর্তী বেড়িবাঁধের বাইরের বাড়ি ঘর পানিতে প্লাবিত হয়েছে। নিঝুমদ্বীপের ৩০হাজার’সহ হাতিয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় অর্ধলাখ মানুষ।
ঝড়ের কবলে পড়ে ভেঙে গেছে কয়েকশত কাঁচা ঘর, বাড়ি, দোকান-পাট, গাছ-পালা। জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে নিঝুমদ্বীপের প্রায় সাত শতাধিক মাছের ঘের। এছাড়াও ঝড়ে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় জেলার ৯টি উপজেলার প্রায় বেশির ভাগ এলাকা বিদ্যুৎহীন রয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে না অনেক এলাকাতে। এছাড়া ভারি বৃষ্টিতে সবজি ক্ষেত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
একুশে সংবাদ/সম.টি/ এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :