ঈদের আর একদিন বাকি। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে নানা দুর্ভোগ মাড়িয়ে বাড়ির পথে মানুষের ঢল। তবে সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে রেল ও নৌপথে অনেকাংশে দুর্ভোগ ছাড়াই বাড়ি ফিরছেন মানুষ। পদ্মা ও যমুনা সেতুতে যানজট নেই। তবে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের চন্দ্রাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দীর্ঘ যানজটে ঘরমুখো মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্টরা।
তারা জানান, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ঈদযাত্রায় বাড়ি ফেরায় এবারের দুর্ভোগ কম হচ্ছে। এ ধারা কর্মস্থলে ফেরার সময়ও অব্যাহত থাকলে এটা বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে। এজন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ, সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত অন্যরা এবং রেল ও লঞ্চ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতদের মাঠে সক্রিয় থাকতে হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, গাজীপুরের বিভিন্ন পয়েন্টে শনিবার সকাল থেকে যানজট ছিল। ওই রুটে চলাচল করা বাসগুলোর ঢাকায় ফিরছে দেরিতে। এজন্য গতকাল রাজধানীর মহাখালী টার্মিনালে পরিবহণ সংকট দেখা দেয়। শনিবার দুপুর ১২টায় দেখা যায়, হাজারো যাত্রী বাসের অপেক্ষায় তীব্র গরমে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। তাদের ভোগাচ্ছে বাড়তি ভাড়াও। মহাখালী টার্মিনালের পরিবহণগুলো আগাম টিকিট বিক্রি করে না। এখান থেকে উত্তরবঙ্গ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের বাস চলাচল করে।
শনিবার (১৫ জুন) দুপুরে এনা পরিবহণের টিকিট কাউন্টারের সামনে দেখা গেছে হাজারখানেক যাত্রীর দীর্ঘ সারি। টিকিটের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকাদের একজন আব্দুস সাত্তার সুমন জানান, ২ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি; টিকিট দিচ্ছে না।
এনা পরিবহণের সহকারী ব্যবস্থাপক এসএম খালেদ জানান, সকাল থেকে ৬৩টি বাস ছেড়েছে। ৬৫ নম্বর পর্যন্ত বাসের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। পরবর্তী বাসগুলো কখন ঢাকায় ফিরবে, নিশ্চয়তা নেই। তাই টিকিট বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে। বাস আসার খবর এলে বিক্রি শুরু হবে।
ভুক্তভোগীরা জানান, ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে আসা বা যাওয়ায় সর্বোচ্চ ৩ ঘণ্টা সময় লাগে। তবে শনিবার ময়মনসিংহ থেকে ফিরতেই ৫ থেকে ৭ ঘণ্টা লাগছে। শুধু গাজীপুরের চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী নয়, এর আগের প্রতিটি মোড়ে গাড়ির চাপ ও যানজট রয়েছে। তাই দ্বিগুণ সময় লাগছে। বাস সময়মতো না ফেরায় ছাড়তেও দেরি হচ্ছে।
তারা আরও জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৩২০ টাকা। সৌখিন, শ্যামলী বাংলা, আলম এশিয়া পরিবহণে অন্য সময়ে দুই আড়াইশ টাকা নেওয়া হলেও এখন নিচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
এদিকে ঈদযাত্রার চতুর্থ দিন শনিবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে লোকাল (কমিউটার) ট্রেনের টিকিট বিক্রির কাউন্টারে প্রচুর ভিড় দেখা গেছে।
কাউন্টারের সামনে শত শত যাত্রী কাক্সিক্ষত গন্তব্যের টিকিটের জন্য সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। অন্যদিকে কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর ট্রেনগুলোয় তুলনামূলক ভিড় কম ছিল। ফলে অনেকটাই স্বস্তি নিয়ে যাত্রা করেছেন যাত্রীরা। শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ২টি স্পেশালসহ ৬৯টি ট্রেন চলাচল করেছে।
আর ঢাকা থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চেও ছিল না দুর্ভোগ। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে লঞ্চগুলোতে যাত্রীর চাপ ছিল বেশি।
অন্যদিকে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কে শুক্রবার রাতে যানজট তৈরি হয়েছিল। তবে শনিবার সকালে সেই যানজট কেটে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে গতকাল সকাল থেকে সেতুর টোল প্লাজার সামনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। পুলিশ বলছে, এটা যানজট নয়। অতিরিক্ত যানবাহন আসছে, তাই টোল প্লাজার সামনে যানবাহনের দীর্ঘ সারি তৈরি হয়। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতুতে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা-মাওয়া অংশের ৩২ কিলোমিটার সড়কে কোথাও যানজট নেই। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যান চলাচল স্বাভাবিক দেখা যায়। ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে ঈদে ঘরমুখো মানুষ এ এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে মোটরসাইকেল, কার, মাইক্রোবাস ও বাসে নিজ নিজ গন্তব্যে রওয়ানা হতে দেখা গেছে।
কুমিল্লা ব্যুরো জানায়, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউনকান্দি থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত শনিবার কোথাও কোনো যানজট ছিল না। এ পথের যাত্রীরা শনিবার যানজটের ধকল ছাড়াই বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। কুমিলা অঞ্চলের হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি খায়রুল আলম জানানÑশনিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যানজটমুক্ত ছিল। আমরা বিস্তীর্ণ এই মহাসড়কের কোথাও কোনো যানজটের জটলা বাঁধতে দেইনি।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি জানান, শেষ সময়ে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার লাখো মানুষ দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া নৌরুটে ব্যাপকহারে ঘরে ফিরছে। ওই রুটে মানুষের চলাচল নির্বিঘœ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। তবে লঞ্চে মানুষের চাপ বাড়ায় ফিটনেসবিহীন লঞ্চে ওই রুটে পদ্মা পারাপার করতে দেখা গেছে। যাত্রীর চাপ বেশি থাকায় অতিরিক্ত মানুষ নিয়ে ফিটনেসবিহীন লঞ্চগুলো চলাচল করেছে।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, ঈদযাত্রায় ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের গোল চত্বর থেকে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার সড়কে যানজট এড়াতে উত্তরবঙ্গ থেকে ছেড়ে আসা পরিবহণগুলো ভ‚ঞাপুর-এলেঙ্গা আঞ্চলিক মহাসড়কের ২৯ কিলোমিটার পথ ঘুরে এলেঙ্গা চারলেনে প্রবেশ করতে হচ্ছে ঢাকাগামী চালকদের। ফলে প্রায়ই এ সড়কে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। এছাড়া যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে স্থানীয় যানবাহনগুলোকে সড়কে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। এতে স্থানীয়দের চলাচলেও ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। তবে, মহাসড়কে গাড়ির যানজট না থাকলে পরিবহণগুলো উঠতে দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু-ভূঞাপুর-এলেঙ্গা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাথাইলকান্দির যমুনা সেতু বাজার, সিরাজকান্দি বাজার, ন্যাংড়া বাজার, মাটিকাটা, গোবিন্দাসী টি-রোড, ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড, শিয়ালকোল বাসস্ট্যান্ড, সিংগুরিয়া ও পালিমাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যান চলাচলে কখনো ধীরগতি ও কখনো যানজটের কবলে পড়তে হয়।
কুড়িগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী খান পরিবহণের চালক আব্দুল কাদের বলেন, ভোর থেকে মহাসড়কে যানজট ছিল। তাই ১৪ কিলোমিটারের সড়ক সেতু পূর্ব গোল চত্বর থেকে ভূঞাপুর-এলেঙ্গা আঞ্চলিক সড়ক দিয়ে ২৯ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে এলেঙ্গায় পৌঁছতে হচ্ছে তাদের। এ সড়কেও পথে পথে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহগামী প্রান্তিক পরিবহণের চালক ইদ্রিস আলী বলেন, সেতু পূর্ব টোল প্লাজা পার হয়ে পাথাইলকান্দি বাজারে প্রায় ২৫ মিনিট ধরে জ্যামে আটকে ছিলাম। গাড়ি চলছিলই না। যে যানজট দেখতেছি তাতে মনে হচ্ছে এলেঙ্গায় পৌঁছতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। এ সড়কটিও এখন গলার কাঁটা।
এদিকে, এই সড়কটি দিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে আসা ঢাকা ও ময়মনসিংহগামী গাড়ি চলাচল করায় স্থানীয় পরিবহণ চলাচলে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ছে। সড়কে উঠতে ঠিকমতো পারছে না। এরফলে এলাকার সড়কের ব্যবহার করছেন স্থানীয় পরিবহণ চালক ও যাত্রীরা। এ সুযোগে পরিবহণ চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন।
এলেঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মীর মো. সাজেদুর রহমান জানান, সকালে মহাসড়কে যানজট ও গাড়ির দীর্ঘ লাইন থাকলেও বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসে। মহাসড়কে এলেঙ্গা অংশে কোনো যানজট নেই। তবে, জেনেছি আঞ্চলিক মহাসড়কেও ঢাকাগামী যানবাহনগুলো স্বাভাবিক গতিতে চলছে।
একুশে সংবাদ/য.র.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :