সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে জলদস্যুরা। গত তিন মাসে সাতক্ষীরা, কয়রা, দাকোপ, মোংলা এলাকায় জেলে অপহরণ, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনাকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে বন বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানো ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনে এক সময়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছিলো জলদস্যুরা। অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্য ছিলো এই ম্যানগ্রোভ। জেলে, বাওয়ালি থেকে শুরু করে পর্যটকরাও সব সময় থাকতেন ভয়ে। তবে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্যদিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়।
তবে চার বছর পর আবারও সুন্দরবনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বনদুস্যরা। সবশেষ গত ৩ নভেম্বর পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি এলাকা থেকে অপহৃত ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। এসব জেলেদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দাবি করা হয় লাখ টাকার চাঁদা।
নতুন করে সুন্দরবনের আতঙ্ক হিসেবে বেশ কয়েকটি নব্য সৃষ্ট বনদস্যু বাহিনীর নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা এলাকায় মঞ্জু বাহিনী, মোংলা এলাকায় শরিফ বাহিনীর তৎপরতা রয়েছে। ২০১৮ সালে আত্মসমর্পণ করা দস্যুদেরও কেউ কেউ পুনরায় এমন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বনের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কমে আসায় বাড়ছে এ ধরনের অপরাধ।
গত তিন মাসে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকা, বাগেরহাটের শরণখোলা, ঢাংমারি, রামপাল এলাকা, খুলনার দাকোপ ও কয়রা এলাকায় এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার অভিযোগ এসেছে জেলে পরিবার থেকে।
জেলেরা বলেন, সাতক্ষীরা এলাকায় মঞ্জু বাহিনী আমার কাছে ৪৫ হাজার টাকা দাবি করেছে। এখন সবসময় আতঙ্কে থাকি। সুন্দরবনের ডাকাত বাহিনী যাকেই ধরছেন ২০, ৩০, ৪০ হাজার নিচ্ছেন। টাকা দিতে না পারলে তারা আমাদের আটকে রাখেন। এখন বনে যাওয়া খুবই ঝুঁকির ব্যাপার। সরকারের কাছে এ সমস্যা সমাধানের দাবি জানান তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের ঘটনাকে উদ্বেগজনক বলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির আগেই সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুস সাদাত।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতি বনদস্যুদের যেসব খবর আসছে তা উদ্বেগজনক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কমে আসা আরও উদ্বেগজনক। আমরা জানি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন একটু ক্রাইসিসে আছে। সেই ক্রাইসিস তারা একটু একটু কাটাতে শুরু করেছে। তবে বনদস্যুদের এভাবে বাড়তে দিলে সেটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। কোস্টগার্ড, নৌ-বাহিনী, র্যাব আর বন বিভাগকে সমন্বিতভাবে সুন্দরবন নিরাপদ রাখতে কাজ করতে হবে। টহল বাড়াতে হবে, তদারকি বাড়াতে হবে।’
সুন্দরবন বন বিভাগের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, ‘সুন্দবনের ভিতরে সম্প্রতি আমরা খবর পেয়ে অভিযান পরিচালনা করে জেলেদের উদ্ধার করেছি। যখনই এ ধরনের খবর পাই, আমরা তৎপরতা চালাই। এটা আসলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা কঠোর অবস্থানে আছি, অন্যান্য বাহিনীর সহায়তায় এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আমরা আরও সক্ষম হবো।’
র্যাব-৬ এর পরিচালক লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফিন বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম উন্নতির সুযোগ আছে। সুন্দরবনের ভিতরে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির নির্দেশনা পেয়েছি আমরা। সুন্দরবন বিশাল এলাকা। এতবড় রিমোট এলাকায় কাজ করা অবশ্যই চ্যালেঞ্জের। এজন্য আমাদের তথ্য প্রয়োজন। জেলেদের থেকে যখন আমরা তথ্য পাই, তখন আসলে দেরি হয়ে যায়। নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে সুন্দরবনে আমাদের তৎপরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’
২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে।
একুশে সংবাদ/স.ট/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :