এই প্রথমবারের মতো আমেরিকানরা স্পষ্ট একটা বস্তু চিহ্নিত করল, যা তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করে বেইজিং থেকে পাঠানো হয়েছে। মার্কিন গোয়েন্দাদের মতে, এটা একটা প্রহরী বেলুন। তবে বহুস্তরবিশিষ্ট গুপ্তচরবৃত্তি, অর্থনৈতিক, সাইবার, সামরিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াতে প্রতিদিন যা ঘটে চলেছে তার তুলনায় এটা তেমন কিছু নয়। আর প্রযুক্তিগতভাবে তা উচ্চমার্গের কিছু নয়। কিন্তু ক্যারোলিনার আকাশ থেকে শনিবার গুলি করে নামানোর আগ পর্যন্ত এটি এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করেছিল, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চীনের তৈরি হুমকি থেকে খুব একটা পৃথক ছিল না। এটি যে বিষয়টি সামনে এনেছে তা হলো, আজকের বিভক্ত মার্কিন সমাজে হুমকি বিষয়টি কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে। দেখা গেল, হুমকির মুখে ওয়াশিংটনের প্রথম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অন্যের প্রতি আঙুল তুলছে।
বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের সময়ে চীনা বেলুনের আমেরিকার আকাশসীমা অতিক্রম করার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা সিএনএনকে বলেছেন, একে বিশেষভাবে গুরুতর গোয়েন্দা বা জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখা হয়নি। কিন্তু এটি যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা থেকে পূর্ব সমুদ্রতীর পর্যন্ত এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, যেটি সংবাদমাধ্যমে স্পষ্ট হয় এবং ওয়াশিংটনে হইচই ফেলে দেয়। একই সঙ্গে এও দেখা গেল, ভূ-রাজনৈতিক উচ্চ সংকট ও প্রহসনের মুহূর্তে হোয়াইট হাউস কেন দ্রুত বেলুনটি ফাটানো হয়নি, এর ব্যাখ্যা দিতে হিমশিম খায়। দক্ষিণ ক্যারোলিনার কর্মকর্তারা মানুষকে সতর্ক করেছিলেন, তারা যেন চীনা অনুপ্রবেশকারী উড়ন্ত এই বেলুনে তাদের রাইফেল দিয়ে গুলি না ছোড়ে। এ ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বেশ নাজুক অবস্থায় পড়ে যান। কারণ তাঁর রিপাবলিকান সমালোচকরা এ বিষয়ে তাঁকে এক হাত নিয়েছেন। বেলুনের এ ঘটনা সহজভাবে উপেক্ষা করা যায় না। বিশেষত যখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের চীন সফরে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক সংকটের কারণে তা দ্রুত বাতিল হয়ে যায়। সিনেট রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল রোববার এক বিবৃতিতে বলেছেন, চীনকে আমাদের আকাশসীমা নিয়ে উপহাস করতে দেওয়া উচিত হয়নি। যদিও বেইজিং ওই বেলনুকে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকারী বায়ুযান বলে দাবি করেছে এবং তার জন্য অস্বাভাবিকভাবে দুঃখও প্রকাশ করেছে। সমালোচকরা এই ঘটনাকে তার অঞ্চলের বাইরে চীনের শক্তি বাড়ানোর প্রমাণ হিসেবে দেখেন। যার টার্গেটে রয়েছে ব্যবসা, বিশ্ব্ববিদ্যালয় এবং চীনা আমেরিকানরা।
গত বছর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয়ে মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন এবং আগামী বছর রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই সময়ের মধ্যেই বেলনুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে প্রবেশ করেছে। এমতাবস্থায় ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের নমনীয় রাজনীতি যে কূটনৈতিক উত্তেজনা কমিয়ে দিতে পারত, সেই সুযোগটা হয়তো নষ্ট হয়ে গেল। এ ঘটনা শি জিনপিংয়ের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করেছে। তৃতীয়, যার ক্ষমতা ধরে রাখার যৌক্তিকতা কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলার ধরন, লকডাউনবিরোধী অভূতপূর্ব বিক্ষোভ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংকটপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে বেশ ম্লান হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উস্কে দেওয়ার জন্য বেলুন পাঠানো ইচ্ছাকৃত, নাকি একটি ভুল ছিল। কিংবা তুখোড় চীনা সশস্ত্র বাহিনী শীর্ষ নেতৃত্বকে বিব্রত করতে এমনটি করেছে, নাকি ব্লিংকেনের সফরের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উত্তাপ কমানোর প্রচেষ্টা হিসেবে এমনটি করা হয়েছে- সে প্রশ্নও উঠেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যদি এ ঘটনার পাল্টা হিসেবে বেইজিংয়ের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ব্লিংকেনের বাতিল হওয়া সফরে এমন কিছু ছিল, যা নানা সমস্যায় জর্জরিত শি সরকারের সঙ্গে বাড়তি উত্তেজনা প্রশমিত করে দিত। অন্তত গত বছর বালিতে বাইডেনের সঙ্গে চীনা নেতার বৈঠকের ভিত্তিতে সে আশা জাগ্রত হয়েছিল। জল্পনা ছিল, ব্লিংকেনের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে আরেকটি শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণা আসতে পারে। কিন্তু বেলুনের ঘটনা যদি মার্কিন জনমতকে চীনের বিরুদ্ধে আরও ক্ষেপিয়ে দেয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এখন যুক্তরাষ্ট্র্র যখন চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কের সুরক্ষা হিসেবে চারপাশে পাহারা দেওয়ার কথা বলে, তখন বেইজিং বিশ্বাস করে, আমেরিকা তার নিজের প্রভাব বাড়াতে চায়। আর মার্কিন আকাশে একটি বেলুনের আপাত নিরীহ ওড়াউড়ির পর সেটি আরও বেশি আশঙ্কাজনক দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
স্টিফেন কলিনসন: সিএনএনের রাজনৈতিক প্রতিবেদক; সিএনএন থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক।
একুশে সংবাদ/স/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :