AB Bank
ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতি: বাংলাদেশের চিত্র উলটো


মূল্যস্ফীতি-মুদ্রাস্ফীতি: বাংলাদেশের চিত্র উলটো

প্রতীকী ছবি

বেশ কিছুকাল যাবৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতিতে সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও যে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী ধারা শুরু হয়েছে, তা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। আমরা এখনো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারিনি। অথচ এই মুহূর্তে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ বড়ই অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে আমরা যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করছি, তার অনেকটাই বহির্বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। তাদের পরিস্থিতি ঠিক হয়ে এলেও আমাদেরটা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের আগে থেকেই অভ্যন্তরীণভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। 

 

অর্থবছরের ২০২৩-২০২৪ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করা হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। দেশের অর্থনীতির বিদ্যমান বাস্তবতায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যেসব করণীয় তার কোনো উল্লেখ বাজেটে নেই। বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জ্বালানির সংকট শিল্প খাতের উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। এছাড়া অবকাঠামোগত সংকট, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসনের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। এসব দিকে প্রস্তাবিত বাজেটে তেমন কোনো দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অনেক দিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে আমাদের ইনভেস্টমেন্ট-জিডিপি রেশিও ছিল ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এটা ছিল ২৪ দশমিক ০২ শতাংশ। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ইনভেস্টমেন্ট-জিডিপি রেশিও ছিল ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এটা ছিল ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ এবং ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এটা ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে কার্যকর বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশের অভাব রয়েছে। 

 

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। এটা বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশের নির্দেশক নয়। যারা বিদেশি বিনিয়োগকারী, তারা কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের বাস্তব বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই সত্যি; কিন্তু একধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজমান রয়েছে। এ বছর শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। 

 

নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটাও বিনিয়োগকারীরা পর্যবেক্ষণ করছে। বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্তের ফল। কোনো বিনিয়োগকারীই হুট করে কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। বিশ্বের যেসব দেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি। নিকট প্রতিবেশী দেশগুলোর ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি নেপালের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ২৩ শতাংশ। আর আমাদের ক্ষেত্রে এটা ৯ শতাংশের কম। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও কম হওয়ার কারণে আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ব্যাংক ঋণ অথবা বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই মোটামুটি আমাদের অর্থনীতির অবস্থা।  

 

ব্যাংকিং সেক্টর খেলাপি ঋণভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। ফলে উদ্যোক্তাগণ ব্যাংক থেকে অর্থায়ন সংগ্রহের ক্ষেত্রে তেমন একটা সহায়তা পাচ্ছেন না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর উদ্যোগের অভাব রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, আগামী দিনে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো পর্যন্ত আমাদের দেশে যারা ঋণখেলাপি, তারা ক্রমাগত বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন। একজন নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারী যদি কোনো আর্থিক ছাড় বা সুবিধা না পান, পক্ষান্তরে ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে ব্যাংকিং সেক্টরে অনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন, তারা হতাশ হতে পারেন। যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ঋণ গ্রহণকালে জামানত হিসেবে যে সম্পদ বন্ধক দেন, তা বিক্রি করে ব্যাংক ঋণের অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমনকি তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। অর্থাত্, যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তাদের মনে ভীতি সৃষ্টি করতে হবে। যাতে তারা বুঝতে পারেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ অন্য কোনো খাতে প্রবাহিত করার সুযোগ আর তাদের নেই। ব্যাংকিং সেক্টরের বিদ্যমান খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করলে সেই ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে এমন একটি মনোভাব ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া আমাদের শেয়ার মার্কেটকে কার্যকরভাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে উদ্যোক্তাগণ দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেন না। তারা শেয়ার মার্কেট থেকে দীর্ঘমেয়াদি পুঁজি সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের শেয়ার বাজার এখনো বিনিয়োগকারীদের আস্থার স্থল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তাগণ শেয়ার বাজারে তাদের কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী হন না। এই অবস্থা নিরসনের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। শেয়ার বাজারের সুফল সম্পর্কে শিল্পোদ্যোক্তাদের বোঝাতে হবে।


ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করে নেওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যাংক ঋণের আপার ক্যাপ কিছুটা তুলে নিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। আমানতের ওপর প্রদেয় সুদের হার যদি ৬ শতাংশ হয়, তাহলে তো আমনতকারীদের লোকসান হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি সোয়া ৯ শতাংশের বেশি। আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদহার প্রত্যাহার করে নেওয়া হলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণের ব্যাপারে উত্সাহী হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসনের অভাব রয়েছে। একধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে অধিকাংশ ব্যাংকে। এটা নিশ্চিতভাবে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের নিরুত্সাহিত করছে। বাইরে থেকে সবাই দেখতে পাচ্ছে ব্যাংকের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। 

 

অনেকেই বলে থাকেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে। ফলে মূল্যস্ফীতির ওপর পলিসি রেট বৃদ্ধির কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। এখানে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কিছুটা তফাত রয়েছে। আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লেই যে মূল্যস্ফীতি কমবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির পেছনে বহির্বিশ্বের কারণগুলোই মূলত দায়ী। 

 

মূল্যস্ফীতির বৈশ্বিক কারণগুলো তো ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ জিটুপি পদ্ধতিতে সরাসরি উপকারভোগীদের কাছে পাঠানো হবে। এটা নিঃসন্দহে ভালো উদ্যোগ। সামাজিক নিরাপত্তার অর্থ যদি সরাসরি উপকারভোগীদের হাতে পৌঁছানো যায়, তাহলে সেটা নিশ্চিতভাবেই ইতিবাচক হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে তালিকা মোতাবেক অর্থ পাঠানো হবে, সেই তালিকা কতটা সঠিক তার ওপর এর সাফল্য নির্ভর করবে।    

 

বাংলাদেশে যারা আয়কর প্রদানযোগ্য, অর্থাত্ টিআইএনধারী (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর), তাদের অর্ধেকেরও কম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করেন। প্রশাসনযন্ত্র এদের করের আওতায় আনার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যারা টিআইএনধারী, তাদের তো বাধ্যতামূলকভাবে ট্যাক্স রিটার্ন দেওয়ার কথা। কেউ যদি টিআইএন নম্বর গ্রহণ করার পর নিয়মিত রিটার্ন দাখিল না করেন, তাহলে তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবে। টিআইএনধারীদের যাতীয় তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু কেন তাদের চিহ্নিত করে করের আওতায় আনা হচ্ছে না, এটা আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে আমাদের টেরিটোরিয়াল কাভারেজ বাড়াতে হবে। 

 

শহরে তো বটেই, এখন গ্রামাঞ্চলেও অনেক লোক আছেন, যারা কর প্রদানযোগ্য। তাদের চিহ্নিত করে কর নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যারা আয়কর ও ভ্যাট প্রদানের সামর্থ্য রাখেন, তাদের কাছ থেকে আয়কর ও ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কর প্রদানযোগ্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়েছে। এজন্য প্রশাসনযন্ত্রের দক্ষতা বাড়াতে হবে। এছাড়া যারা কর আহরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। তারা যাতে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। করদাতা কর দিলেন; কিন্তু তা যদি সঠিকভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না হয়, তাহলে উদ্দেশ্য সাধিত হবে না।

 

লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা

 

একুশে সংবাদ/ই/এসএপি

Link copied!