রেল দুর্ঘটনা এক-তৃতীয়াংশে নেমে এলেও বড় দুর্ঘটনা থামানো যাচ্ছে না। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে রেললাইনের ত্রুটি বা রেলক্রসিংয়ে গাড়িচালকদের গাফিলতির কারণে। এসব দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে বড় দুর্ঘটনা ঘটছে রেলকর্মীদের গাফিলতিতে।সম্প্রতি ২৩ অক্টোবর সোমবার বিকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনায় কিশেরগঞ্জের জগন্নাথপুর রেল ক্রসিং এলাকায় আন্তনগর এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেন ও একটি মালবাহী ট্রেনের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় এগারোসিন্দুর এক্সপ্রেসের কয়েকটি বগি যাত্রীসহ উল্টে যায়। মালবাহী ট্রেনটি সিগন্যাল না মানায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে হতাহতের সংখ্যা শতাধিক আহত হন ।আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
> সিগন্যালিংয়ের জটিলতার কারণে দুর্ঘটনা ॥ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ সিগন্যালিংয়ের জটিলতার কারণে হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে রেলওয়ে কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে রেলওয়ের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (পূর্ব) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম জানান, মালবাহী ট্রেনটি সিগন্যাল অমান্য করায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে।’ পরে এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানা যাবে বলে জানান তিনি।এ বিষয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার জানান, ‘ঢাকা থেকে একটি কন্টেনারবাহী ট্রেন ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করছিল। তার আগ মুহূর্তে ভৈরব থেকে এগার সিন্ধুর ট্রেন ঢাকার দিকে আসছিল। জগন্নাথপুর রেলক্রসিং এলাকায় এগার সিন্ধুর ট্রেনের শেষের দু-তিনটি বগিতে কন্টেনারবাহী ট্রেনের ইঞ্জিন আঘাত করে। মূলত সিগন্যালিংয়ের কোনো জটিলতার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার পর থেকে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে। উদ্ধার কাজের জন্য রিলিফ ট্রেন পাঠানো।’ উদ্ধার কাজ শেষ হলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে বলে জানান তিনি।
সারা দুনিয়াতেই রেল নিরাপদতম যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের রেলপথ সড়ক বা নৌ পথের তুলনায় নিরাপদ হলেও রেলপথে জীবন ও সম্পদহানিকর দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত।
> দুর্ঘটনার চালচিএ :-২০১৮ সাল থেকে ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ইখ পর্যন্ত রেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩০২ জন। এ সময় রেল দুর্ঘটনা ঘটে ১ হাজার ১১৬টি।
রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেল দুর্ঘটনার একটা বড় অংশই লাইনচ্যুতির ঘটনা। এতে প্রাণহানি কম। বেশির ভাগ প্রাণহানি হয় এক ট্রেনের সঙ্গে অন্য ট্রেনের সংঘর্ষ কিংবা রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায়।রেলপথে দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৯’ অনুসারে ৩৯৩টি রেল দুর্ঘটনায় ৮৯ নারী ও ৪৬ শিশুসহ ৪২১ জন নিহত এবং চার নারী ও ৩৩ শিশুসহ ৩৬৬ জন আহত হয়েছে। আর বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেব অনুসারে ২০১৯ সালে রেলপথে ৪৮২টি দুর্ঘটনায় ৪৬৯ জন নিহত ও ৭০৬ জন আহত হয়েছে। ২০২১ সালে রেল পথে ২৭০টি দুর্ঘটনায় ২৫৪ জন নিহত ও ৪২ জন আহত।বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আর সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে। চলুন দেখা যাক এসব দুর্ঘটনার পেছনে কাঠামোগত সমস্যার ভূমিকা কি।
২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ এই দশ বছরে মোট ২ হাজার ৪২৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ২ হাজার ১৫৫ টি যা মোট দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশ।
> ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ: বাংলাদেশ রেলওয়ে ইনফরমেশান বুক ২০১৮ থেকে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৭-১৮ এই দশ বছরে মোট ২ হাজার ৪২৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ২ হাজার ১৫৫ টি যা মোট দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশ। আর ট্রেন লাইন চ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তার মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ, ইঞ্জিন বা বগির যান্ত্রিক সমস্যা, সিগনাল ব্যবস্থার সমস্যা, বিভিন্ন ধরণের মানবীয় ভুল ও নিয়ম অমান্য করা ইত্যাদি। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় সর্বোচ্চ। ক্ষমতাসীন সরকার ১৪ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। উচ্চব্যয়ে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প নিতে যতটা উৎসাহ দেখা যায়, ততটাই নিরুৎসাহ বিদ্যমান রেলপথ ও রেলসেতু সংস্কারে। ফলে সারা দেশে মানসম্পন্ন রেললাইন রয়েছে ৭৩৯ কিলোমিটার, যা মোট রেললাইনের মাত্র ২৫.২৩ শতাংশ। রেলসেতু ঝুঁকিপূর্ণ ৪০২টি। লাইনে পাথরস্বল্পতা, রেলক্লিপ ও নাট-বল্টু চুরি হয়ে যাওয়ায় নড়বড়ে ট্র্যাক মেরামতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও যন্ত্রাংশের অভাবে রেললাইনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথের পাশাপাশি ২৭৮ ইঞ্জিনের মধ্যে ১৯৫টির এবং ১ হাজার ৬৫৬টি কোচের মধ্যে ৯০০টির আয়ু শেষ। আবার এগুলোর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজও সঠিক ভাবে করা হয়না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রেলের পূর্বাঞ্চলে ২০ শতাংশ বগি বার্ষিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মেরামত ছাড়াই চলছে। লোকবলের অভাব এবং বগির স্বল্পতার কারণে এই কাজ হচ্ছে না। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে মিটারগেজের ১২ শতাংশ এবং ব্রডগেজের ৮ শতাংশ বগি সময়মতো মেরামত হয়না।
আবার, একটি যাত্রীবাহী ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছালে এর ইঞ্জিন ও বগি ৪৫ মিনিট ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নিয়ম। এ সময় বগি ধোয়া-মোছা, কলকব্জা পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু এই কাজে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ ছাড়া তিন মাস পরপর মেরামত কারখানায় নিয়ে বগির দিনব্যাপী পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিয়ম আছে। এক বছর পর কারখানায় নিয়ে বড় ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মেরামতের কথা। এসবের জন্য বরাদ্দও আছে। কিন্তু নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজটাই ঠিকভাবে হয় না।
> যেভাবে দুর্ঘটনা
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটেছে ভৈরব স্টেশনের বাইরে, যেখানে একাধিক লাইনের জোড়া রয়েছে। এখানে ট্রেন এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যায়। ফলে দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। এতে আরও বড় বিপর্যয় হতে পারত।
রেল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সূত্র বলছে, দুটি ট্রেন একই লাইনে বা একাধিক লাইনের মোড়ে আসার সুযোগই নেই। এ ক্ষেত্রে স্টেশনমাস্টার মালবাহী ট্রেনটিকে আউটারে থামার সংকেত না দিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো স্টেশনের আউটার হচ্ছে ট্রেনগুলোকে অপেক্ষায় রাখার জায়গা। অন্য ট্রেনকে জায়গা দিতে আউটার এলাকায় ট্রেন থামার লাল বাতির সংকেত (সিগন্যাল) আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
অন্যদিকে থামার সংকেতবাতি দেওয়ার পরও চালক তা না মানলে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে রেল কর্তৃপক্ষ দেখেছে, মালবাহী ট্রেনটির চালক থামার সংকেত উপেক্ষা করে দ্রুত ট্রেনটি চালিয়ে এসে এগারসিন্দুর ট্রেনটিকে ধাক্কা দেন।
উদ্ধারকাজে ব্যস্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। সোমবার বিকেলে ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে
উদ্ধারকাজে ব্যস্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
রেলের পূর্বাঞ্চলের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা (জিএম) নাজমুল ইসলাম বলেন, চালক সংকেত না মেনেই চলে এসেছেন বলে মনে হয়েছে। এরপরও দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে। এরপর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালবাহী ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও পরিচালককে (গার্ড) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, এগারসিন্দুর ট্রেনটি ভৈরব রেলস্টেশন থেকে ঢাকার পথে আসছিল। আর মালবাহী ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনাটির সময় এগারসিন্দুর ট্রেনটি এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাচ্ছিল। এগারসিন্দুর ট্রেনটি লাইন পরিবর্তনের জায়গা অতিক্রম করে ১১টি কোচ পার হয়ে যায়। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনটি এগারসিন্দুরের শেষ তিন কোচে আঘাত করে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি চালক সংকেত অমান্য করে চলে আসেন, সে ক্ষেত্রে হেমন্তের বিকেলে সবকিছু দূর থেকেই পরিষ্কার দেখার কথা। অর্থাৎ একই লাইনে অন্য একটি ট্রেন আছে দেখে গতি কমিয়ে থামানো যেত। সেটা কেন করা হয়নি, তা–ও একটি প্রশ্ন।
দুর্ঘটনার সময়ের দুটি ভিডিও পেয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা যায়, সামনে ট্রেন দেখে জোরে হর্ন বাজাচ্ছিল মালবাহী ট্রেনটি। তখনো এর গতি ছিল বেশি। কিন্তু পরে একেবারে যাত্রীবাহী ট্রেনে ধাক্কা দেওয়ার আগে কিছুটা গতি কমানো হয়।
> হতাহতদের পরিচয়
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ জনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। এর মধ্যে ২১ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। অন্যান্য হাসপাতালে নেওয়া হয় আরও অন্তত ৩০ জনকে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক পরিবারের চারজন রয়েছেন। তাঁরা হলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সুজন মিয়া (৩৫), তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৩০), তাঁদের দুই ছেলে সজীব মিয়া (১৪) ও ইসমাইল মিয়া (১০)। অন্য ১১ জন হলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দড়িগাঁও গ্রামের আছির উদ্দিন (৩০), মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের রাসেল মিয়া (২১), চানপুর গ্রামের সাইমন মিয়া (২৬), ভৈরব পৌর শহরের টিনপট্টি এলাকার বাসিন্দা সুবোধ শীল (৪৫), ভৈরব যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ জালাল আহমেদ, ঢাকা কলেজের ছাত্র ভৈরবের রাধানগর গ্রামের আফজাল হোসেন (২৩), রানীরবাজারের সবুজ চন্দ্র শীল (৫০), শ্রীনগরের রাব্বি মিয়া, ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মেরেঙ্গা গ্রামের হোসনা আক্তার, কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুরের ইমারুল কবীর (২২) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বরইছড়া এলাকার নিজাম উদ্দিন সরকার।
> উদ্ধার তৎপরতা
দুর্ঘটনার পর ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন লাগোয়া জগন্নাথপুর এলাকার লোকজন প্রথমে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। উদ্ধারকাজে অংশ নেন স্টেশনের হকাররাও। মূলত তাঁরা কোচের ভেতর থেকে আহত ব্যক্তিদের বের করে এনে হাসপাতালে পাঠান। পরে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, ডিবি পুলিশ ও যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা এসে কোচের ভেতর থাকা মরদেহ বের করে আনেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকাজে যুক্ত জগন্নাথপুর এলাকার জাহিদ হাসান বলেন, ‘বিকট শব্দ আর মানুষের চিৎকার কানে আসার পর ধারণা করছিলাম হয়তো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। ভেতর থেকে অসংখ্য মানুষের চিৎকারের শব্দ আসছে। বাইরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেকে। সবার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।’
উদ্ধারকাজ তদারকির জন্য দুই ঘণ্টা পর কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ, ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিকুর রহমান, র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মো. আলী আক্কাস ঘটনাস্থলে আসেন।ডিসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, উদ্ধারে একাধিক দলের সদস্যরা কাজ করছেন। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন স্থানীয় সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান।
এখন প্রশ্ন হলো এক ট্রেনের সাথে আরেক ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা তো বাংলাদেশে প্রথম নয়। ১৭ এপ্রিল ২০২৩ রোববার সন্ধ্যায় কুমিল্লার হাসানপুর স্টেশনে একটি মালবাহী ট্রেনকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় সোনার বাংলা এক্সপ্রেস। তাতে ট্রেনের কয়েকটি বগি উল্টে যায়। আহত হন অন্তত পঞ্চাশ যাত্রী।
দেশের দ্রুতগামী ট্রেনের একটি সোনার বাংলা এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে আসছিল। পথে কুমিল্লা শহরের আগে নাঙ্গলকোট উপজেলার হাসানপুর রেল স্টেশন।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, ‘ভুল’ সিগন্যালের কারণে দ্রুতগতির সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মেইন লাইন ছেড়ে লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে। এ সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী ট্রেনটিকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সেটির উপরে উঠে পড়ে সোনার বাংলা এক্সপ্রেস। কাত পড়ে পড়ে এর পাঁচটি বগি। ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিন্দীতে গোধুলি ও চট্টলা – এই দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল কারণ চট্টলার চালক সিগনাল অমান্য করেছিল। রেলওয়ের তদন্ত রিপোর্টে তখন বলা হয়েছিল চালক ভৈরব স্টেশানে চা পান করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় নাকি এই সংকেত অমান্য করার ঘটনাটি ঘটেছিল!৫৯ চালক অজ্ঞান হোক, ঘুমিয়ে পড়ুক বা অবহেলা করুক, প্রশ্ন হলো একই ধরনের দুর্ঘটনা দ্বিতীয়বার কেন ঘটবে? এতদিনেও কেন ট্রেন চালনার সময় চালকদের উপর নজরদারি, স্টেশন ও ট্রেনের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা কিংবা স্বয়ংক্রিয় ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা চালু করা হলো না?
> অরক্ষিত রেলক্রসিং: রেল দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে আর সবেচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে। রেলওয়ের হিসাব অনুসারে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সারা দেশে মোট ৮৬৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় ১১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। লেভেল ক্রসিংয়ে ৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯৯ জন। তাঁদের প্রায় সবাই ক্রসিং পার হতে যাওয়া বাস, মাইক্রোবাস ও ছোট যানবাহনের আরোহী। রেলক্রসিং পারাপারের সময় যেসব পথচারী প্রাণ হারান, সেই হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে না। রেলওয়ের হিসাবে, সারা দেশে রেলক্রসিং আছে ২ হাজার ৫৭৪টি। এর মধ্যে অনুমোদিত রেলক্রসিং ১ হাজার ৪৬৮টি। অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ ক্রসিং অবৈধ। অনুমোদিত বলতে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের সময় রেলের অনুমোদন নিয়েছে। ক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক ও অবকাঠামো তৈরি এবং কর্মী নিয়োগের পর ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ দেওয়ার পরই অনুমতি পাওয়া যায়। ফলে অনুমোদিত ক্রসিং সুরক্ষিত রাখা রেলের দায়িত্ব। অথচ প্রতিবন্ধক, পাহারাদার এবং ট্রেন চলাচলের খবরাখবর জানা যায় এমন ব্যবস্থা আছে মাত্র ৫৬৪টি ক্রসিংয়ে। অর্থাৎ বৈধ বাকি ৯০৪টি ক্রসিংয়েও কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। এসব ক্রসিংয়ে সতর্কবার্তা–সংবলিত সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় সারছে রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে যে দুর্ঘটনাগুলো সহজেই প্রতিরোধযোগ্য।
রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৭৪। এগুলোর মধ্যে অনুমোদন নেই ১ হাজার ৪৬৮ টির। অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ ক্রসিং অবৈধ। অনুমোদিত বলতে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের সময় রেলের অনুমোদন নিয়েছে। আর এসব ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। আরও আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে। সব মিলিয়ে দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত।রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রেলপথে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, এর ৮৫ শতাংশই মারা যান রেলক্রসিংয়ে। অবশ্য রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যুর হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ রাখে না। মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, এক ট্রেনকে অন্য ট্রেনের ধাক্কা, রেলক্রসিংয়ে গাড়িকে ট্রেনের চাপা—এসবকে দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রেলওয়ের নথিপত্র অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে রেলক্রসিংকে নিরাপদ করতে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করেছে রেলওয়ে। দুটি প্রকল্পের আওতায় রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭০২টি রেলক্রসিং উন্নয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৩২ জন। রেলক্রসিং উন্নয়নের মধ্যে প্রতিবন্ধক বসানো ও পাহারাদারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরপরও রেলক্রসিং নিরাপদ হয়নি।
রেললাইনের ওপর উড়ালপথ নির্মাণে এক যুগের বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে। সওজ অল্প কিছু মহাসড়কের উড়ালসড়ক নির্মাণ করেছে। অন্যগুলোতে উড়ালসড়ক নির্মাণ কে করবে, সেটাই ঠিক করতে পারছে না সংস্থাগুলো। ফলে অরক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
এর আগে ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিংদীতে চট্টগ্রামগামী গোধূলীর সঙ্গে ঢাকাগামী চট্টলার মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক জহির মিয়াসহ ১৩ জন নিহত হন। চট্টলার চালক সংকেত অমান্যের কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ নিয়ে রেলের পূর্বাঞ্চল গঠিত। এই অঞ্চলে যাত্রী বেশি পরিবহন হয়। পদ্মা নদীর পশ্চিম পারের জেলাগুলো নিয়ে রেলের পশ্চিমাঞ্চল গঠিত।
পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক কার্যালয়ের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ২০১০ সালে ২০৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালে ১৬৫, ২০১২ সালে ১৩৮, ২০১৩ সালে ১৬৭ এবং ২০১৪ সালে ১৪৭টি দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার হার কমে এলেও ২০১৩ ও ২০১৪ সালে নাশকতার কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। ওই সময় দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছিল।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ২০১৫ সালে দুর্ঘটনা কমে আসে। ওই বছর ৮৮টি, ২০১৬ সালে ৬৭টি, ২০১৭ সালে ৭১ এবং ২০১৮ সালে ৭২টি দুর্ঘটনা নথিভুক্ত করে পূর্বাঞ্চল। আর ২০১৯ সালরর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দুর্ঘটনা হয় ৫০টি।রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাপরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে ৮৮টি রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ১৫ জন। ২০১৪ সালে ১৪৭ দুর্ঘটনায় মারা যান ১৯ জন। ২০১৬ ও ২০১৭ সালের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। তবে পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটেছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে রেলক্রসিংয়ে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর গাড়িচালকদের অসতর্কতাকে দায়ী করেছে। দুই বছরে রেলক্রসিংয়ে ২৮টি মাঝারি আকারের দুর্ঘটনার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৫টি দুর্ঘটনার জন্যই যানবাহনচালকদের দায়ী করেছে রেলের তদন্ত কমিটি। কেবল একটি দুর্ঘটনার জন্য গেটম্যানকে দায়ী করা হয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে নিয়মিত ঘটতে থাকা বিভিন্ন দুর্ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায় এমন সব কাঠামোগত কারণে বার বার মর্মান্তিক সব দুর্ঘটনা ঘটে যার অধিকাংশ কারণই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জানা থাকার কথা ঙএবং সুনির্দিষ্ট কতগুলো পদক্ষেপ নিলে সেইসব দুর্ঘটনার হার বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু নানা কারণে এই অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো না নেয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদ্যমান ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা চলমান থাকাই বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য লাভজনক, ফলে এসব গোষ্ঠির প্রভাবে কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধানের পথে বাধা তৈরি হয় । আবার দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয় তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হলেও তাৎক্ষণিক লাভ লোকসান বিবেচনায় অনেকেই এই বিনিয়োগটুকু করতে চায় না। আর এ কারণেই নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক তদারকি এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি দেখে দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের কোনো শাস্তি বা ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে না তাহলে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিনিয়োগের কোনো তাগিদ সেই প্রতিষ্ঠানের থাকে না। বিপরীতক্রমে দুর্ঘটনা ঘটলে যদি তার পুঙ্খানুপঙ্খ তদন্তের মাধ্যমে দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তরালের বিভিন্ন কাঠামোগত কারণ উন্মোচন করে তার জন্য সংশ্লিষ্টদের সকলকে শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের মুখোমুখি করা হয় তাহলে ঐ প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সকল ধরণের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বনে বাধ্য হয়।
একুশে সংবাদ/স ক
আপনার মতামত লিখুন :