সম্প্রতি ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নীতি অবলম্বন করে মালদ্বীপে চীনপন্থি মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিছুদিন আগে লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ভারতীয়দের মালদ্বীপ ভ্রমণে না গিয়ে বরং লাক্ষাদ্বীপে পর্যটক হিসেবে যাওয়া উচিত। ওই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মালদ্বীপের এক উপমন্ত্রী মোদিকে ‘জোকার’ অভিহিত করায় ভারতে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই মন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হলেও ওই প্রতিক্রিয়া স্তিমিত হয়নি। এখন ভারতীয় পর্যটকরা দলে দলে মালদ্বীপ ভ্রমণের বুকিং বাতিল করে তাদের পর্যটন শিল্পে ধস নামানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে ভারত থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টির প্রয়াসও পরিলক্ষিত হচ্ছে। অবশ্য এহেন ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মুখে পরাভব না মেনে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু মালদ্বীপ থেকে ভারতের ৮৮ জন সামরিক ব্যক্তিকে প্রত্যাহারের জন্য ২০২৪ সালের ১৫ মার্চকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তাঁর এই ‘আলটিমেটাম’কে ভারত অপমানজনক মনে করছে।
আরও উস্কানিমূলক হলো, প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু তাঁর প্রথম বিদেশ সফরের গন্তব্য হিসেবে চীনকেই বেছে নিয়েছেন। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত বিষয়টির সুরাহা কীভাবে হয়। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ভারতের বিভিন্ন বক্তব্য ও পদক্ষেপ তার সব প্রতিবেশী দেশের জনগণের মধ্যে ‘ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট’ সৃষ্টি করে চলেছে। ভারতের জন্মশত্রু পাকিস্তান ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী গণচীনের কথা বাদ দিলেও নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এহেন ভারত-বিরোধিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ৯৫ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও নেপালের মানুষ ভারতকে প্রচণ্ডভাবে অপছন্দ করছে। ২০১৪ সালে মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপরই নেপালের জ্বালানিসহ পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে ওই দেশের অর্থনীতিকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নেপালিরা ভোলেনি; ভবিষ্যতেও সহজে ভুলবে না।
এখান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় হলো, অতিমাত্রায় চীনের দিকে না ঝুঁকে ভারত ও চীনের ব্যাপারে সুপরিকল্পিত ভারসাম্য রক্ষা করা অপরিহার্য। যদিও চীন বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস, তবুও দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ভারতকে ক্ষেপিয়ে বাংলাদেশ তেমন কোনো ফায়দা পাবে না। ভারত থেকে যেসব পণ্য বাংলাদেশ আমদানি করে, সেগুলো অন্যান্য দেশ থেকে আনতে গেলে শুধু খরচই বাড়বে না, নানাবিধ বিঘ্নও সৃষ্টি হবে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতকে একটি আংশিকভাবে সফল দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় হলো, কোনো অজুহাতেই প্রকৃত গণতন্ত্র বিঘ্নিত করা যাবে না; লাইনচ্যুত করা যাবে না। গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কারণেই বাংলাদেশকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে এক নদী রক্ত ও দুই লাখ নারীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কবল থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হয়েছিল। আবার ১৫ বছরের সামরিক স্বৈরশাসন উৎখাত করার জন্য ১৯৯০ সালে একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করতে হয়েছে বাংলাদেশের জনগণকে। অতএব, এ দেশের জনগণের সর্বাপেক্ষা বড় আমানত হলো গণতন্ত্র। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার নামে কোনো শাসক যদি এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়, তা বাংলাদেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না।
বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের শেষদিকে এসে ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে। ২০২২ সালের ভারত বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালে ভারতে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ফলে গত ৩২ বছরে ভারতের অর্থনীতিতে প্রশংসনীয় গতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালে ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পেছনে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশেও বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা সৃষ্টি হওয়ায় ২০২৪ সালে এসে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে যে দেশটিকে ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, সে দেশকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ২০২০ সালে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ ঘোষণা করেছেন। আইএমএফ ঘোষণা করেছে, ২০২১ সালে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাপে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, জেন্ডার সমতা এবং বাড়ির বাইরে কর্মরত নারীর অনুপাতের মতো অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অগ্রগামী।
অবশ্য এসব তথ্য নিয়ে আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই। কারণ, স্বীকার করতে হবে, জীবনযাত্রার মানের বিচারে বাংলাদেশের জনগণ এখনও ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের জনগণের কাতারে উন্নীত হতে পারেনি। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলকে প্রধানত সমাজের উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীর করায়ত্ত করে ফেলেছে। যার ফলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগণ আজও অর্থনৈতিক সচ্ছলতার সন্ধান পায়নি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। এসব মৌল-প্রয়োজনীয় (বেসিক নিডস) জিনিসপত্র ও সেবার দাম সাধারণভাবে ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে কম। ভারতে মূল্যস্ফীতির হারও বাংলাদেশের অর্ধেকের কম। বিশেষত, ভারতে সাধারণ জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো হলেও সেগুলো কম ব্যয়বহুল ও সহজলভ্য। দামে সুলভ হওয়া সত্ত্বেও মানের দিক থেকে ভারতের স্বাস্থ্যসেবা এরই মধ্যে বিশ্বে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে পৌঁছেছে। কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর মতো কয়েকটি ভারতীয় রাজ্য তার রাজ্যের সব নাগরিকের খাদ্য নিরাপত্তা, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। সব ধরনের পরিবহন ব্যয়ও ভারতে অনেক কম। এমনকি জমির দাম, বাড়ির দাম, বাড়ির নির্মাণ ব্যয় ও বাড়ি ভাড়া ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের ভিত্তিতে এখনও ভারতের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ইন্ডিকেটর্স অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতের মাথাপিছু জিএনআই ছিল ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার; বাংলাদেশে ৬ হাজার ৬৯০ পিপিপি ডলার। মোদ্দা কথা, ভারতের সাধারণ জনগণের জীবন বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের জীবনের তুলনায় বেশি ব্যয়-সাশ্রয়ী। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতের কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং পশ্চিম ভারতীয় রাজ্য হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। অবশ্য উত্তর ভারতের বিহার, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর জনগণের চেয়ে বাংলাদেশের জনগণ অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করছে; বলা যায়। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক সূচকে এরই মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে।
ভারতে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের শিকড় সুদৃঢ়ভাবে প্রোথিত। যে জন্য ওখানে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অত্যন্ত কার্যকর ও শক্তিশালী। বিশেষত কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুবই প্রতিনিধিত্বশীল ও গণতান্ত্রিক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিক্ষা নিতে পারে। ‘কেরালা মডেল’ বিশ্বে ‘জনগণের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন’-এর আদর্শ ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা, বৈষম্যহীন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা, বেকার ভাতা, রাজনৈতিক পরমতসহিষ্ণুতা ও জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়েও বাংলাদেশ নির্দ্বিধায় কেরালাকে অনুসরণ করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ‘অপারেশন বর্গা’ বাংলাদেশের জন্য কৃষি সংস্কারের আদর্শ মডেল হওয়ার দাবি রাখে।
ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার এবং তা ক্রমবর্ধমান। যে কারণে ওখানে কোনো ডলার সংকট নেই। ভারতে অভিবাসীদের রেমিট্যান্স আসে বিশ্বের সব দেশের চেয়ে বেশি, প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। ওখানেও হুন্ডি ব্যবস্থা (যেটাকে তারা ‘হাওয়ালা’ বলে) ক্রিয়াশীল। কিন্তু হাওয়ালা ব্যবসা ভারত থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারে অপব্যবহৃত হয় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে, কীভাবে কঠোর হাতে পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। বর্তমানে এই হুন্ডি ব্যবসার দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশের ফর্মাল চ্যানেলে পাঠানো রেমিট্যান্স তেমন বাড়ানো যাচ্ছে না। কারণ হুন্ডি ব্যবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অধিকাংশ বৈদেশিক মুদ্রা পুঁজি পাচারকারীরা বিদেশে পুঁজি পাচারের জন্য অপব্যবহার করছে। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাচ্ছে; ডলার সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং ডলারের বাজারে একাধিক দাম চালু রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও ভারত বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি সফল। ভারতের উল্লিখিত সাফল্যগুলো থেকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা শিক্ষা নিতে পারেন।
একুশে সংবাদ/ক.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :