মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। গোটা রমজান মাসের সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন পালিত হয় ঈদুল ফিতর। যেহেতু মুসলিমরা চান্দ্র মাস অনুসরণ করেন সেহেতু বছরের যেকোনো ঋতুতেই অনুষ্ঠিত হতে পারে এটি। আরবি ঈদ শব্দের আভিধানিক অর্থই উৎসব। সারা বিশ্বের মুসলিম এদিন উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠেন, যদিও দেশ ও সংস্কৃতি ভেদে এ উৎসবের ধরন নানারকম হতে পারে।আর বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ দেশ। এখানে ঈদের আনন্দটা দেখার মতো।আর ঈদ হল সেই দিন পালনের নাম, যা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। ঈদ মানে ফিরে আসা। যেহেতু খুশির বার্তা নিয়ে ঈদ প্রতিবছর ফিরে আসে এবং মানুষ তা পালন করে। তাই তাকে ঈদ বলা হয়। মুসলমানদের ঈদ হয় কোন দ্বীনী উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। মহান আল্লাহর ইবাদত পরিপূর্ণ করে এবং তাঁর রাসূল (সা:) এর বিধিবদ্ধ শরিয়ত অনুযায়ী তাঁকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে তা পালন করা হয়।
সহজ ভাষায় ঈদের অর্থ হচ্ছে নতুনকে পাওয়া, দিনটি আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাটিয়ে দেওয়া। যেখানে থাকবে না কোনো দুঃখ-দুর্দশা। প্রাণ খুলে আমরা শান্তি ও পরকালীন মুক্তির অন্বেষণে ঈদ উদযাপন করতে পারি। ঈদের দিন মানুষে মানুষে মিলনের অঙ্গীকার। কিন্তু বর্তমান সমাজের বাস্তবতায় এই অঙ্গীকার যেন আগের মতো থাকছে না। ধনী-গরিবের বৈষম্য এতো বেড়ে গেছে যে, ঈদের দিনের মিলনটা একটা প্রথাগত মিলনে পরিণত হতে যাচ্ছে।
ঈদের দিনে আত্মীয়তার একটি বন্ধন নির্মিত হয়। এ আত্মীয়তা হচ্ছে কাছের ও দূরের সকলের সাথে আত্মীয়তা। আমরা ঈদের দিনে সমাজের নানাবিধ বৈষম্য থাকা সত্বেও একে অন্যের কাছে আসি। কর্মক্ষেত্রে মিলনের মধ্যে অনেক সময় স্বার্থের সম্পর্ক বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু ঈদের দিনের মিলনে একটি সুন্দর অভিব্যক্তি আছে। এই মিলনে স্বার্থের সম্পর্ক নেই, আছে কেবল ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার তাগিদ।
ঈদ আনন্দ ছোটদের মধ্যে একরকম, বড়দের মধ্যে অন্যরকম। ছোটরা দুই ঈদের আনন্দ ভিন্নভাবে পালন করে থাকে। ঈদুল ফিতরের আনন্দ নতুন জামা-কাপড় পরিধান করে পালন করে থাকে। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, প্রতিবেশীর মহল্লায় মহল্লায়, ফিন্নি সেমাই নানা ধরনের বাহারি আপ্পায়নে আনন্দকে উপভোগ করে। সাপ্তাহ পর্যন্ত এই আনন্দ তাদের মধ্যে চলতে থাকে।
> গ্রামের ঈদের আনন্দ :-
আজ গ্রামের প্রতিটি রাস্তা পাকা হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ি পাকা হয়েছে। কেউ আর দুপুরে না খেয়ে থাকে না। প্রতিটি লোকই ঈদে নতুন পোশাক পরে। ঈদের আগে কেনা কাটার কমতি নেই কারো। অজ পাড়াগাঁয়ের তকমা বিলিন হয়েছে। অভাব অধিকাংশের পরিবার থেকে বিদায় নিয়েছে। গ্রামের প্রায় সব মানুষের ঘরে খাবার আছে, হাতে আছে টাকা। শুধু তাই নয় সরকারেরও সক্ষমতা বেড়েছে হাজারগুণ। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় গ্রামের গরীব লোকগুলোকে সহায়তার গণ্ডির মধ্যে নিয়ে এসেছে। গ্রাম পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে ঈদের আগে সরকারের খাদ্য সহায়তার চমৎকার ব্যবস্থাপনা ঈদ আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমরা যারা এখন শহুরে রাস্তার ক্লান্তিকে পায়ে মাড়িয়ে শেকড়ের টানে, মায়ার টানে মাটির টানে ঈদ আনন্দে অন্তর পূর্ণ করতে গ্রামে আসছি। তবে গ্রামের সমাজের গাঁথুনিটা সেকালের থেকে একালে অনেকটায় আলগা হয়ে গেছে। গ্রামের এক সমাজ ভেঙে হয়েছে তিন-চারটি। মমত্ববোধ আর ভ্রাতৃত্ববোধের ঘাটতির পরিধি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তারপরও বাড়ি আাসার আগে মন বলে উঠে ‘স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার’। আবার শহরের অনেক লোককে বলতে শুনি ‘ঈদ আসছে গ্রাম আগের মতোই টানে, আবেগটাও আছে কিন্তু বাবা-মা নেই কোথায় যাবো?’ তাদের এই আবেগের মূল্য দিতে পারবো না। তাঁদের কষ্টটা পূরণ হবার নয়। তাঁদের জন্য আমাদের সমবেদনা।
গ্রামের ঈদ সবারই হৃদয়ের অনুভূতির জায়গাটা দখল করে থাকে আমৃত্যু।
যে আবেগ তা একালের হোক কিংবা সেকালের হোক সবার হৃদয়কেই নাড়া দেয়। আমাদের বোধকে জাগ্রত করে। তাই তো আমরা পথের কষ্টকে গায়ে না মেখে বারে বারে ফিরি নিজের অথবা বাপ-দাদার নাড়ি পোঁতা গ্রামে।
পরিশেষে বলতে চাই, ছোটবেলায় ঈদ ছিল অন্যরকম এক আকর্ষণ। ঈদকে কেন্দ্র করে সবার মধ্যে উৎসব ও আমেজের ভাব বিরাজ করতো। ছোটবেলায় আমার গ্রামের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় ঈদ উদযাপন করা হতো। বাড়িতে ছোটদের সবাই দল বেঁধে রমজান মাসের শেষের দিকে এসে ঈদের অপেক্ষায় থাকতাম। এর অবশ্য অন্য একটা বড় কারণ ছিল ঈদকে কেন্দ্র করে বড়দের থেকে নতুন কাপড়চোপড়সহ নানা উপহার সামগ্রী পাওয়া যেতো। আর ভালো খাওয়া দাওয়ার নানা আয়োজন চলত। আমাদের বড় পরিবার। তাই ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে নিয়ে ঈদকেন্দ্রিক নানা আয়োজন হতো। এর মধ্যে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোসহ আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার অন্যরকম মজা ছিল।
এ-মজা আজকাল যেন অনেকটা কমে গেছে। কারণ বর্তমান সময়ে ঈদের জামাত আদায় করার পর কোলাকুলি পর্ব শেষে খাওয়া দাওয়া করে অনেককেই টেলিভিশনের হরেক রকমের অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই দেখা যায়।
নানা ব্যস্ততায় এখন আর আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া খুব একটা হয়ে ওঠে না। তবে তরুণদের মধ্যে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদের বাসায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর প্রচলন এখনও আছে।আর ছোটবেলার ঈদ উদযাপন সবার কাছেই অন্যরকম মজা। যদি বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘ঈদের মজা আপনার কাছে এখন কেমন?’--তবে একবাক্যে সবাই ছোটবেলার ঈদ উদযাপনের কথাই বলবেন। তখন দল বেঁধে ঈদের জামাত শেষে ঘুরে বেড়ানো, নতুন কাপড়চোপড় পরা, বড়দের কাছ থেকে নগদ টাকা পাওয়া ও বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে গিয়ে খাওয়া দাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।
আর বর্তমান যুগে ঈদকে সামনে রেখে বেড়ে যায় চাঁদাবাজি। অফিস আদালতের কর্তারা ঈদের দোহাই দিয়ে বাড়িয়ে দেন ঘুষের রেট আবার অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে বাড়িয়ে দেন পণ্যের মুল্য। বর্তমানে অনেকেই পাড়া বা মহল্লার মসজিদ বা ঈদগাহের পরিবর্তে জেলা সদরের বড় ঈদগাহ মাঠ বা বাংলাদেশের বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠে গিয়েও ঈদের জামাত পড়তে দেখা যায়। তবে এতে পড়শীদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করা সম্ভব হয়না। আবার কোথাও কোথাও কুলাকুলি করার প্রবণতাও হ্রাস পেয়েছে বিভিন্ন কারনে।
বর্তমানে পত্র পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে কর্মী সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেও দেখা যায় রাজনৈতিক বা সামাজিক অনেক নেতা পাতিনেতাকে। তবে নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে ঈদকে উপল করে নেতাদের কর্মতৎপরতা ব্যাপকহারে বাড়তে দেখা যায়। তখন শুরু হয় ভোটারদের মোবাইল নাম্বার অনুসন্ধানের হিড়িক। অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করা হয় ভোটারদের নামে এসএমএস পাঠাতে।
তবে নির্বাচনের পরে অনেকেই ভুলে যান ভোটারদের কথা। তখন বেড়ে যায় চাটুকারদের কদর। এছাড়াও হাল জমানার ঈদ ও আগের জমানার ঈদে আরও যথেষ্ঠ ব্যবধান রয়েছে যা আমাদের প্রবীণ মুরব্বীয়ানদের সাথে আলাপ করলে জানা যায়।
আর ঈদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝার জন্য রমজানের তাৎপর্য অনুভব করতে হয়। রমজানের সিয়াম সাধনার পরিণতিতেই ঈদ উৎসবের আয়োজন। এ উৎসবের প্রধান অংশই হচ্ছে ঈদের জামাত ও খুতবা। ঈদের জামাতে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ একত্রিত হয় এবং পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। ঈদের জামাতের খুতবায় দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নের পাশাপাশি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির জন্যও দোয়া করা হয়। ঈদের নামাজে আত্মার শান্তি পাওয়া যায় এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়। ঈদের জামাতের সাহায্যে পরিশুদ্ধতা এবং পবিত্রতা প্রকাশের চেষ্টা করা হয়। আর ঈদ আমাদের নিজকে চেনায়। তাই তো ঈদের আগে গণমাধ্যমেও খবর হয় নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ। এরই নাম ঈদ, এরই নাম আনন্দ। আমাদের হৃদয়ে থাকুক আমাদের গ্রাম। সবার ঈদই হোক আনন্দময়। নিরাপদ হোক সকলের ঈদ যাত্রা। সকলকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
একুশে সংবাদ/এস কে
আপনার মতামত লিখুন :