পৃথিবীর ইতিহাস বলে, সর্বত্রই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো জনপদ। কিন্তু বহু জনপদে মানুষ সেই নদীকে কোনো প্রতিদান তো দেয়ইনি, বরং ভাগাড়ে পরিণত করেছে। যেমন মনোমুগ্ধকর নদী বুড়িগঙ্গাকেও আমরা ধীরে ধীরে মেরে ফেলেছি। অথচ বুড়িগঙ্গা এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকা ও উৎসবের অংশ হয়ে থাকার কথা ছিল। এখনও যদি এ নদীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না আনা যায় তাহলে ঢাকাকে বাঁচানো যাবে না।
মোগলরা বুড়িগঙ্গা নদীটির জোয়ার-ভাটার রূপ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিল এবং এর তীরের ঢাকা শহরকে সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ঢাকা শহরের জন্য বুড়িগঙ্গা নদী অর্থনৈতিকভাবেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নদী দিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলে লঞ্চে যাতায়াত করা হয় এবং দেশি নৌকা চলাচল করে। বাংলাদেশকে নদীমাতৃক বলা হতো। গ্রামবাংলা, শহর অর্থাৎ পুরো বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে ছিল নদীর ওপর ভিত্তি করে।
বুড়িগঙ্গা ঘিরে যে সভ্যতা তৈরি হয়েছে, সেই সভ্যতাই নদীটির দখল ও দূষণের অন্যতম কারণ। অধিক মাত্রায় জনসংখ্যা ঢাকাকে আজ দূষিত রাজধানী করে তুলেছে। বুড়িগঙ্গাকে আজও বলা হয় ঢাকার হৃদয়; অথচ মানুষের হৃদয়হীন আচরণে বুড়িগঙ্গার প্রাণ ওষ্ঠাগত। দখল ও দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা হারিয়েছে যৌবন, বুড়িগঙ্গার পানি হয়ে পড়েছে ব্যবহার অনুপযোগী। দূষিত পানি ও দুর্গন্ধের জন্য নদী-তীরবর্তী এলাকায় স্বাস্থ্যগত সমস্যা তীব্র। অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। বুড়িগঙ্গা এখন শুধু দেশেরই নয়, দুনিয়ার অন্যতম দূষণাক্রান্ত নদী। এ নদীর পানি তার স্বাভাবিক রংও হারিয়ে ফেলেছে দূষণের কারণে। বুড়িগঙ্গার দূষণ দেশের অন্য সব নদীর জন্যও কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু মানববর্জ্যই নয়, শিল্পকারখানার বর্জ্য, রাজধানীর ময়লা-আবর্জনা এবং নৌযানের সব ধরনের আবর্জনা নির্বিচারে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গা যেভাবে জলজ প্রাণীর জীবন ধারণের অযোগ্য হয়ে পড়েছে, তা উদ্বেগজনক। বুড়িগঙ্গার পানি দিয়েই গোসল, রান্নাসহ যাবতীয় কাজ করত অসংখ্য মানুষ। আর এখন বুড়িগঙ্গার পানি গায়ে লাগলেই চর্মরোগের আশঙ্কা থাকে।
এই অবস্থা এক দিনে হয়নি। কোনো প্রতিকার ছাড়াই বছরের পর বছর থেকে এই নদী ক্রমাগত দূষিত হয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে এখনই মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন অপরিহার্য। কারণ বুড়িগঙ্গা মারা পড়লে ঢাকা পরিত্যক্ত নগরী হিসেবেই বিবেচিত হবে। ঢাকার চারপাশের নদনদীতে ভয়াবহ দূষণের কারণে এসব নদীর পানি শোধন করা সম্ভব হয় না। ফলে ঢাকা ওয়াসা ক্রমবর্ধমান হারে ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই নির্ভরশীল, যা ভবিষ্যতে এই নগরীর পরিবেশের ভয়াবহ সর্বনাশ ডেকে আনবে। অতি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দুর্যোগের ঝুঁকিও প্রবল।
এখন রূপকথার মতো শোনাবে যে বুড়িগঙ্গায় জাল ফেলে মাছ ধরে ভালোই দিন কাটত জেলেদের। এই নদীতে বর্ষাকালে অল্পস্বল্প হলেও মাছ পাওয়া যায়। বৃষ্টি বাড়লে বুড়িগঙ্গায় মেলে শিং, মাগুরসহ দেশীয় প্রজাতির মাছ। কিন্তু দূষিত বুড়িগঙ্গার নতুন আতঙ্ক ‘সাকার ফিশ’। অনেকে ‘রাক্ষুসে মাছ’ বলে। এ মাছের কারণে বুড়িগঙ্গা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য মাছ। বুড়িগঙ্গার যে কোনো ঘাটে দাঁড়ালে পানিতে এই মাছের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। মাছটি সাধারণ কোনো মাছ নয়। দেখতেও ভয়ানক। শরীরে ছোট ধারালো কাঁটাযুক্ত এই মাছ অন্য মাছ খেয়ে ফেলে। এ ছাড়া এই মাছ আবর্জনা ও ময়লা খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারে। সরকার কর্তৃক বিক্রি ও প্রজনন নিষিদ্ধ থাকায় সাকার মাছ বিক্রি করেন না জেলেরা। সাকার মাছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতুসহ রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে এবং এই মাছ দেশীয় মাছ বিলুপ্তি করতে পারে এবং বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে দিতে পারে বলে শঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের। অথচ এই মাছে ভরে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা।
ম্যাগাসিটি রাজধানী ঢাকার দুই কোটি মানুষের মলমূত্রসহ বিভিন্ন কলকারখানা, গৃহস্থালির ২০ হাজার ঘনমিটারের বেশি বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। শিল্পবর্জ্য, পয়োবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। পানি থেকে ছড়ানো গন্ধে অতিষ্ঠ দুই পাড়ের মানুষ। আশপাশের ফসল, মাছ, মাটি, পানিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্পকারখানার বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যাল, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল-মবিল, টনকে টন বিষ্ঠা বুড়িগঙ্গাকে বিষে জর্জরিত করে তুলছে।
দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পায়নি বুড়িগঙ্গার খালগুলোও। এক সময়কার টলমলে পানির খালগুলো এখন পরিণত হয়েছে দুর্গন্ধযুক্ত নালায়। ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানিতে নদী পারাপার হচ্ছে স্থানীয় মানুষ। এ ছাড়াও খালের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। অবৈধভাবে দখলকৃত স্থানে গড়ে উঠেছে রিকশা-ভ্যানের গ্যারেজ। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার অবস্থা এখন নাজুক। নদী হয়ে গেছে সংকুচিত। যেটুকু আছে তা ভরে আছে সব বিষাক্ত পদার্থে। এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত রাজধানী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা অত্যাচারে-অনাচারে, দূষণে মৃতপ্রায়। এর ঐতিহাসিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। বুড়িগঙ্গার ভরাট, দখল, শুকনো ও হারিয়ে যাওয়া অংশ দখল উচ্ছেদ ও খননের মাধ্যমে নদীপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রবহমান অংশের তীরবর্তী দখল উচ্ছেদের পর তা স্থায়ী করতে নজরদারি ও তদারকি প্রয়োজন। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকার অন্য নদীগুলোর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ সারাবছর নাব্য রাখার। নদীতীর দখলমুক্ত করে জনসাধারণের জন্য হাঁটাচলার রাস্তা তৈরির সঙ্গে লাগানো যায় দেশীয় গাছ। সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে দীর্ঘ মেয়াদে বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
একুশে সংবাদ/স.ল.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :