শুক্রবার ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস-২০২৪। তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবছরও বাংলাদেশে দিনটি যথাযথভাবে পালিত হবে। বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে জোরালো করতে ১৯৮৭ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে বছরের একটি দিন বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
প্রথম বছর ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উদযাপিত হলেও একই বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলেনে ৩১ শে মে তারিখ নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৯ সাল থেকে সমস্ত পৃথিবীতে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে জনসচেতনতা বাড়াতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সরকারিভাবে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। কিন্তু সরকারিভাবে এখনো জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয় না।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে তামাকবিরোধী জোট দেশব্যাপী জাতীয় তামাকমুক্ত দিবস উদযাপন করে আসছে। সারা দেশে বিগত বছরগুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে কর্মরত সংগঠনগুলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন, কর বৃদ্ধি, ধূমপানমুক্ত স্থান বৃদ্ধি, প্যাকেটের গায়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান, তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়গুলো প্রধান্য দিয়ে সভা, সেমিনার, অবস্থান কর্মসূচি, র্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে আসছে।
তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার দিনকে দিন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। তামাকের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুস ক্যান্সার, মুখ গহ্বরের ক্যান্সার, ডায়াবেটিকস্, এজমাসহ নানা রোগ বাড়ছে। এসব রোগ প্রাণঘাতী, চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি। এরপরও দেশের প্রায় ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। যার মধ্যে কিছু শতাংশ ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করে এবং কিছু শতাংশ ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করে।
তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে বেশি। ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্য যেমন-জর্দ্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদিও ফসফুসের অপূরণীয় ক্ষতি করে। এর মধ্যে অতি ৩০ ধরনের ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ ধরনের নাইট্রোস্যামিন পাওয়া যায়, যা ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ফুসফুস ছাড়াও মুখগহ্বর, গলনালী এবং পাকস্থলি ক্যান্সারের জন্যও দায়ী এই ধোঁয়াবিহীন তামাক।
বাংলাদেশে সবচেয়ে কম মূল্যে তামাকজাত দ্রব্য কিনতে পাওয়া যায়। ফলে দরিদ্যদের মধ্যে তামাকের ব্যবহার বেশি। এজন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তামাকের প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। সবরকম তামাকজাত পণ্য থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে তার দ্বিগুণের বেশি অর্থ তামাকজাত রোগের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতে হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে হৃদরোগ জনিত মৃত্যুর প্রায় ১২ শতাংশের জন্য দায়ী তামাক ব্যবহার এবং পরোক্ষ ধূমপান। হ্রদরোগের কারণ হিসাবে উচ্চ রক্তচাপের পরেই তামাক ব্যবহারের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন (আইএইচএমই)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০০৫ থেকে ২০১৬ সময়কালে বাংলাদেশে অকাল মৃত্যুর কারণের তালিকায় হৃদরোগ ৭ম স্থান থেকে ১ম স্থানে উঠে এসেছে এবং এই পরিবর্তনের হার প্রায় ৫৩ শতাংশ। আর এই মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসাবে তামাকের অবস্থান চতুর্থ।
ধূমপান শুধু ব্যবহারকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে না, উপরন্তু যারা তাদের আশেপাশে থাকে তারাও এর ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তারা না চাইলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপান সংক্রামক এবং অসংক্রামক উভয় রোগ সৃষ্টি করে। বিশেষভাবে শিশু, নারী ও নারীর গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে দেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে যে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে তার কারণে প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকারদের সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দেন।
তামাকের ইংরেজি ‘ট্যোবাকো’ এসেছে স্প্যানিশ ‘ট্যাবাকো’ শব্দ থেকে। এই শব্দটির উৎপত্তি আরাওয়াকান ভাষা থেকে। তামাক গাছের আদি নিবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়। তামাক গাছের শুকানো পাতাকে তামাক বলা হয়। তামাক গাছ ১২-১৮ ইঞ্চি লম্বা হয়। এটি নেশাদায়ক পদার্থ। তামাকে আগুন দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, হুঁকো ও অন্যান্য ধূমপানের মাধ্যম প্রস্তুত করা হয়। ধূমপান ছাড়াও তামাক বিভিন্ন মাধ্যমে জর্দা, খৈনি, নস্যি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তামাকের মূল নেশাদায়ক উপাদান নিকোটিন এক প্রকারের স্নায়ুবিষ (নিউরোটক্সিন), যা এক ধরনের অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টরের (কোলিনার্গিক অ্যাসিটাইলকোলিন রিসেপ্টর) উপর কাজ করে।
প্রথমদিকে তামাক চাষ কম হলেও ২০০৯-১০ সালের শুরু থেকেই তামাক কোম্পানিগুলা কৃষককে পাতার দাম বাড়ানোর লোভ দেখায়। এতে কোম্পানিগুলা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ জমি এবং নতুন নতুন জেলা তামাক উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে রাঙ্গামাটি, চলনবিল, নাটোর, যশোর, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট, রংপুর, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, পাটুরিয়া এবং টাঙ্গাইলে ব্যাপক জমি তামাক চাষের আওতায় আনা হয়েছে।আর বাংলাদেশের কৃষকরা অধিকাংশই দরিদ্র। এক ফসল ঘরে তুললেও নতুন ফসল উৎপাদনের জন্য কোন অর্থ তাদের হাতে থাকে না। তাই ঘরের ফসল বিক্রি করে নতুন ফসল ফলানোর কাজে ব্যয় করা হয়। তাদের এ দারিদ্র্যতাকে কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো ফায়দা হাসিল করছে।
শর্ত সাপেক্ষে সার কীটনাশক প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানের জন্য চাষীরা ঝুঁকে পড়েছে তামাক চাষে। কোম্পানির নানামুখী কৌশলে তামাক চাষে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। এ কারণে অনিচ্ছায় তামাক চাষ বেছে নিতে হয়েছে। যেমন, প্রতি একর জমিতে টোব্যাকো কোম্পানি ২০ হাজার টাকা করে ঋণ দিচ্ছে। পাশাপাশি বীজ ও সার দিচ্ছে। এ জমিতে ধান-পাট বা অন্যান্য ফসল আবাদ করে লাভবান হওয়া যাচ্ছে না। দাম কম হওয়ায় আবাদের খরচ পুষিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। আর প্রাকৃতিক দূর্যোগ তো রয়েছেই। কিন্তু কৃষকদের ধারনা তামাক চাষে পরিশ্রম বেশি হলেও আয় বেশি। এ চাষ ছেড়ে সবজি চাষে পরপর দু’বছর তেমন কোন সুবিধা করতে পারা যায় না।
কোম্পানির দেয়া শর্ত মেনে নিয়ে সার ও কীটনাশক পাওয়া গেলেও তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক জানার পরও তামাক চাষে বাধ্য হচ্ছেন। বিভিন্ন এনজিও তামাক চাষের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বিকল্প ফসল আবাদ করার পরামর্শ দিলেও চাষীরা তা মানতে নারাজ। কারণ তামাকের জমিতে নতুন করে অন্য ফসল আবাদ করলে প্রথমে ভাল ফল পাওয়া যায় না। তাই চাষীরা কোম্পানির দেয়া প্রলোভনে পড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছে।
তামাকে প্রধানত বিষাক্ত পদার্থ নিকোটিন থাকে। এছাড়া নানা ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে, যেমন বেঞ্জোপাইরিন ইত্যাদি বহুচক্রী আরোমাটিক যৌগ। একটা সিগারেটে যতটুকু তামাক আছে তা শরীরে প্রবেশ করলে এতে দ্রুত মৃত্যু অনিবার্য। তবে ধূমপানের ফলেও ধীরে ধীরে আয়ু কমে আসে এবং হৃদরোগের জন্যও তামাকের মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।
তামাকের উচ্ছিষ্টাংশ হৃদপিন্ডে ঢুকে ক্যান্সারসহ মরণব্যাধি হতে পারে। আর এ কারণে অধিকাংশ লোকই নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের কিংবদন্তি লেখক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মূলত ধূমপানজনিত কোলন ক্যান্সারকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। এক জরিপে জানা যায়, বাংলাদেশে ধূমপানের কারণে প্রতি বছর ৬০ হাজার মানুষ মারা যায় এবং তামাকজনিত কারণে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়।
আর বাংলাদেশে মাদক সমস্যা এখনও পাশ্চাত্যের মতো ভয়াবহ না হলেও মাদকদ্রব্যের ব্যবহার বাড়ছে। একটি দেশের মেরুদন্ড হচ্ছে তরুণ ও যুবসমাজ। আর এই ভয়াবহ মরণ নেশার নির্মমতার প্রধান শিকার হচ্ছে এই তরুণ ও যুবসমাজ। এক জরিপে দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের শতকরা ৮০ ভাগ তরুণ ও যুবক। মাদকের কারণে আমাদের দেশের তরুণ ও যুবসমাজ আজ মারাত্মক বিপর্যয়ে, মাদক সেবনের ফলে তারা জীবনীশক্তি, সৃজনশীলতা, নৈতিকতা ও মেধা হারাচ্ছে।
ফলে এদের অধিকাংশই জড়িয়ে পড়ছে নানান অসামাজিক কর্মকান্ডে। এদেশের শহরে জনপদে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন ও সন্ত্রাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে মাদকের অপব্যবহার। মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারের ফলে যেমন চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন ও সন্ত্রাস বেড়ে চলেছে এতে আইনশৃংখলারও চরম অবনতি হচ্ছে।তাই খাদ্যের জমিতে তামাক চাষ খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। তামাক চাষ বিভিন্ন খাদ্য ভান্ডারের জমি দখল করে নিচ্ছে। জমিতে তামাক চাষের ফলে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছর বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্যে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
তামাক চাষ শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এই বিষবৃক্ষ চাষ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপনন সকল ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত করছে জনসাধারণকে। তামাক পাতা উঠানোর মৌসুমে বাড়ির নারী, পুরুষ শিশু-কিশোর সকলকে এক সাথে মাঠে কাজ করতে হয়। এ সময় শিশুরা স্কুল কামাই করে তাদের অভিভাবকদের সাথে মাঠে কাজ করে। ফলে তামাক চাষিদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে তাদের শিক্ষাজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় বিপুল সংখ্যক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
> তামাকে স্বাস্থ্যহানিঃ-
তামাক সেবন একটি মারাত্মক বদ অভ্যাস। পরিসংখ্যায় দেখা যায় বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করেন আরো কয়েক লাখ মানুষ। এখনও দেশে প্রায় ৪ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন।এর কারণে ক্যান্সারের মতো রোগ হয়। ধূমপান ও তামাক সেবনে সাময়িক কিছুটা ভালো লাগলেও এর কোনো উপকার নেই। তামাকের ধোঁয়ার মধ্যে প্রায় ৩৫টি কার্সিনোজেন এবং ধোঁয়াহীন তামাকের মধ্যে ২৪টি কার্সিনোজেন থাকে। কার্সিনোজেন হচ্ছে এমন পদার্থ বা কেমিক্যাল, যা ক্যান্সার সৃষ্টি করে বা ক্যান্সার সৃষ্টিতে সহায়তা করে। কার্সিনোজেন ছাড়াও তামাকে থাকে নিকোটিন, যা নেশার সৃষ্টি করে এবং রক্তনালির সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে হাই ব্লাডপ্রেশার হয়। এ ছাড়া রক্তবাহী নালির ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করে এবং সেখানে চর্বিজাতীয় পদার্থ জমতে থাকে। ফলে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। একসময়
হয়তো রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে স্ট্রোক হতে পারে। তামাক সেবনের কারণে ফুসফুসে, স্ব্বরনালি, মুখগহ্বরে, গলনালি, খাদ্যনালি, পাকস্থলী, মূত্রথলি, কিডনি, নারীদের জরায়ুমুখ, ব্রেস্ট, অগ্ন্যাশয়ে ক্যান্সার হতে পারে। ক্যান্সার ছাড়া ধূমপানে অন্য যেসব রোগ হয়, সেগুলো হচ্ছে হাই ব্লাডপ্রেশার, স্ট্রোক, এনজিনা পেকটোরিজ, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, পচন রোগ এবং কিছু চর্মরোগ। গর্ভবতী নারীদের গর্ভস্থ শিশুর ওজন কম এবং ছোট হওয়া তামাক সেবনের আরেক জটিলতা। কাজেই ধূমপান ও তামাক সেবন করে থাকলে আজই তা ত্যাগ করুন।
> তামাক বর্জন করার উপায়ঃ
অনেক ধূমপায়ী আছেন যাদের তামাক বর্জনে সদিচ্ছার কোন ঘাটতি নেই। তামাক নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য বিধায় এটা ছাড়তে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। তামাক ও তামাক-জাতীয় দ্রব্য বর্জনের ব্যাপারে চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করুন। তবে নিজের সদিচ্ছা, মানসিক শক্তি এবং দৃঢ়তার মাধ্যমে তামাক বর্জন করা যায়:
১. নিজেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- নিজের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করুন, ইচ্ছাশক্তি বাড়ান এবং তামাকজাত দ্রব্য ছাড়ার জন্য একটি তারিখ ঠিক করুন। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যে কোন সময় তামাক ছাড়া যায়। ক্যালেন্ডারে একটি তারিখ ও সময় নির্দিষ্ট করে রাখুন এবং সে দিন ক্ষণ থেকে বর্জন শুরু করুন।
২. পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যেমন- বাড়ি, অফিস এবং গাড়িতে কোন প্রকার তামাকজাত দ্রব্য রাখা যাবে না। তামাক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের আশপাশে না যাওয়া ভাল।
৩. প্রেরণা ও সহযোগিতা- যেমন আপনার পরিবার-পরিজন, বন্ধু এবং সহকর্মীদের বলুন তারা যেন প্রতিনিয়ত তামাক ও তামাক জাতীয় দ্রব্য ছাড়ার ব্যাপারে আপনাকে উৎসাহিত করেন।
৪. গ্রুপভিত্তিক পদক্ষেপ- তামাক ছাড়ার ব্যাপারে দলগত পদক্ষেপ অনেক কার্যকর। এক্ষেত্রে গ্রুপভিত্তিক কার্যক্রম উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়।
৫. প্রয়োজনে ডাক্তার, নার্স, ফার্মাসিস্ট, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক অথবা স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ নিতে হবে।
৬. নতুন নতুন কৌশল- ধূমপানের ইচ্ছা হলে সে সময় মনকে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে হবে। কারো সাথে কথা বলা, হাঁটা, চলাফেরার মাধ্যমে এটা সম্ভব।
৭. তামাক বর্জনের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমানোর জন্য ব্যায়াম করা, খেলাধুলা করা, বই পড়া এবং নামাজ, দোয়া, ধ্যান এবং ধর্মীয় কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করুন। এতে মানসিক অস্থিরতা কমে আসবে এবং তামাক ও ধূমপান বর্জনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
৮. প্রচুর পানি ও বিশুদ্ধ তরল খাবার গ্রহণ করুন।
৯. প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। তামাক বর্জনের প্রথম কিছু দিন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- মাথা ব্যথা, বিষণ্নতা, ক্লান্তি, হতাশা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বিরক্তি, ঘুম না আসা, ক্ষুধামন্দা, অস্থিরতা ইত্যাদি। তবে এ সমস্যাগুলো দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করে এবং ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে তামাক ও ধূমপান বর্জন করে সুস্থ-সুন্দর ও স্বাস্থ্য-সম্মত জীবন-যাপন করা যায়।
পরিশেষে বলবো, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১৯৫৬ সালের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে তামাক পণ্যকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হোক।তামাক সবচেয়ে বেশি আবর্জনা সৃষ্টিকারী পণ্য। যেখানেই সিগারেট, বিড়ি খাওয়া হয়, সেখানেই তার ছাই এবং শেষাংশটা আবর্জনা হয়ে থাকে। যেখানে পানের সাথে জর্দা, সাদাপাতা খাওয়া হয়, সেখানে লাল থুথু পড়ে পরিবেশ নষ্ট করে। গুল ব্যবহারকারীদের ছোট ছোট প্লাস্টিকের কৌটা যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
যেসব কার্যালয় ধূমপান বা তামাকমুক্ত নয়, সেখানে সিঁড়ির ধাপে ধাপে বালি দিয়ে একটা পাত্র রাখা হয়, যেন সিগারেটের শেষাংশ (Butt) সেখানেই ফেলা হয়, যদিও ধূমপানকারীদের সেই হুঁশ সব সময় থাকে না। রাস্তাঘাটে, রেলস্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে, সমুদ্রের তীরে, এমনকি হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই সিগারেট বাট পাওয়া যায় আবর্জনা হিসেবে। বাড়িঘরে ড্রয়িংরুমে এশট্রে বা ছাইদানি রাখা হত ধূমপায়ী মেহমানদের সিগারেট আবর্জনা ফেলার জন্যে। যা ভরে গেলে ঘরে আবর্জনার সৃষ্টি করে। বাস বা গাড়িতে বসে যারা ধূমপান করেন তাদের বেশিরভাগ অনায়াসে সিগারেট খাওয়ার পর জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেন; নৌযানে যারা যান তারা নদীতে ফেলে দেন, রেলের যাত্রীরা চলন্ত অবস্থায় বাইরে ফেলে দিয়ে বসে থাকেন।
সিগারেট বাট দেখতে কাগজের তৈরি মনে হলেও আসলে এটা একধরণের প্লাস্টিক, যা cellulose acetate (সেলুলুজ এসিটেট) জাতীয় প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এবং এর মধ্যে রয়েছে শতাধিক বিষাক্ত কেমিক্যাল দ্রব্য। এগুলো মাটিতে মিশে যেতে কমপক্ষে ১০ বছর লাগবে, আর এর মধ্যে যে কেমিক্যাল রয়েছে তা পরিবেশে আরো অনেক বছর থেকে যাবে। প্রায় ৪.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট বাটের প্লাস্টিক আবর্জনার শিকার হচ্ছে এই বিশ্ব। বাংলাদেশে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ১২ কোটি ৩০ লক্ষ সিগারেট খাওয়া হয়, অর্থাৎ সমপরিমাণ বাটের আবর্জনা ফেলে দেয়া হয়। এখানে যারা মাঝে মাঝে সিগারেট খান তাদের সংখ্যা যোগ করলে আরো বেশি বাটের আবর্জনা সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন ৭ কোটি ২০ লক্ষ বিড়ি সেবন করা হয়, যার সমপরিমাণ বাট আবর্জনা তৈরি হয়।
সিগারেটে প্রায় ৭০০০ কেমিক্যাল আছে যা একদিকে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে অন্যদিকে সিগারেটের শেষাংশ মাটি এবং পানিকে দূষিত করে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র কণার প্লাস্টিক ভেঙ্গে গিয়ে কেমিক্যালগুলো পরিবেশ দূষিত করে।
তামাক, ধোঁয়াযুক্ত বা ধোঁয়াবিহীন, যাই হোক না কেন, এর উৎপাদনও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটে।
আর তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে তামাক কোম্পানির মালিকানা ত্যাগ করতে হবে। তামাক নয়, রাজস্ব আহরণের নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রত্যাশা থাকবে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গাইডলাইনটির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ‘আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত’ ঘোষণা বাস্তবায়নে সরকার কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সেক্ষেত্রে বলা যায়, ভবিষ্যতে একদিন বাংলাদেশে সব ধরনের তামাকজাত পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ হবে। এর পথ তৈরিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকা থেকে সিগারেটকে বাদ দেয়া প্রয়োজন সর্বাগ্রে। নইলে অন্যান্য আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।তাই মাদক ব্যবসায়ীদের বিরোদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে। মাদকের প্রতি কৌতুহলি হয়ে কেউ যাতে মাদকাসক্ত হয়ে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আর ইতিমধ্যে যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সঠিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি পাগল নয় খারাপ নয় কিন্তু সে অসুস্থ্, আপনার আমার সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবই একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করতে পারে। তাই আসন্ন বাজেটে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তামাকের মূল্য ও কর বৃদ্ধি প্রয়োজন।
লেখক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ইমেইল, [email protected]
একুশে সংবাদ/ এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :