দেশজুড়ে চলছে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন। এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন ছাত্রসমাজ। ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশে অনেক বিষয়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এসেছে দেশের স্বাধীনতার উদ্দীপনাসহ অনেক বৈপ্লবিক সংশোধন।
তবে অনেকে বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোকে ধ্বংস করেছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোর কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই। বিশেষ করে উচ্চশিাকেন্দ্রগুলোকে হত্যা, কলহ, বিবাদ, সংঘর্ষের লীলাক্ষেত্র পরিণত করেছে এই সর্বনাশা ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররাজনীতির কারণেই এ দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই মৌলবাদের আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে।
১৯৭৫ সালের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে সংঘটিত প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীলতা আসন গেড়ে বসলে বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মানবিকতা ও বিকাশশীলতা নির্বাসিত হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংক্রমিত হয় নানামাত্রিক সন্ত্রাস। জ্ঞানচর্চার চেয়ে ত্রাসসৃষ্টিকে মহিমান্বিত করার সংস্কৃতি পৃষ্ঠপোষকতা পায় ব্যাপকভাবে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির নামে যা হয়, তা কেবল পরিবারতন্ত্র, দখল, দুর্নীতি বৈ অন্য কিছু নয়।
যাদের কেবল আইন প্রণয়নের এখতিয়ার রয়েছে, তারা লিপ্ত থাকে মতাচর্চায়। কথা ছিলো, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বাংলাদেশ, কোনো ব্যক্তির নয়, মানুষ অধীন থাকবে গণতান্ত্রিকভাবে প্রণীত আইনের ও সংবিধানের, সব মানুষের থাকবে সমান অধিকার, কোনোটাই হয়নি, গণতন্ত্রই যেখানে নির্বাসিত হয়েছিলো, সেখানে আর কীই বা প্রত্যাশা করবার সুযোগ থাকে। সে যাই হোক, ছাত্ররাজনীতি বলতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যা চলে তা খতিয়ে দেখলে যা পাওয়া যায় তা হলো, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক কিছু সংগঠন অস্ত্রসহযোগে সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ততার নামে নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রাবাস, ছাত্রাবাসে আবাসনের অপ্রতুলতাকে পুঁজি করে বাধ্য করা হয় দলীয় মিছিলে। কারও কোনো স্বকীয় মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধার বালাই নেই। শিক্ষার্থীদের বোধ বিবেচনাকে দলিত করে নিয়ে যাওয়া হয় দলীয় মিছিলে, এই সরকারের আমলে তা সেই প্রবণতা কিছুটা কম দেখা গেলেও আগে এই প্রবণতা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছিলো।
এমনও শুনেছি, অস্ত্র হাতে নিরীহ নবাগত ছাত্রকে রাতের পর রাত পাহারায় বসিয়ে রাখা হতো যাতে অন্যরা হল দখলে নিতে না পারে, বিশেষ করে রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে গত এক দশকের যে খবরাখবর শুনি তাতে করে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বৈকি। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনগুলোর দৌরাত্ম্য সাধারণ ছাত্ররা সর্বদাই সিটিয়ে থাকে, আতঙ্কিত থাকে।
বায়ান্ন, উনসত্তুর, একাত্তর, নব্বুই প্রভৃতি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অর্জন মূলত ছাত্র আন্দোলনের অবদান, ছাত্রদের ত্যাগের মাধ্যমে এইসব অর্জন বাংলার ইতিহাসের, সেই ত্যাগের মহিমাকে ছাত্ররাজনীতির মহিমা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করে আসা হচ্ছে। বাস্তব সত্য হচ্ছে, ছাত্র আন্দোলনের পথে পুরোটা সময় ধরেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে আসছে ছাত্ররাজনীতি। ছাত্ররা যে কোনো জনসমাজের সবচাইতে সংবেদী ও বিশুদ্ধ সম্প্রদায়, ছাত্রদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ওপরই একটি সমাজের বিকাশ নির্ভর করে। কেবল মতাচর্চায় লিপ্ত যে কারো কাছে মতাকাঠামোতে অবস্থানই সবচে বড় বিবেচ্য, মতারোহনই তার প্রধান অভিষ্ট লক্ষ্য।
ছাত্র আন্দোলন মানেই ছাত্রদের দ্বারা ভাংচুর বা নৈরাজ্য নয়, ছাত্র আন্দোলন মানে রাস্তা বন্ধ করে মিছিল করা নয়। এ কয়দিন ধরে দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে যা হচ্ছে তা দুঃখজনক।
এদিকে ১৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সরকারি চাকরিতে `কোটা` ইস্যু নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা সংগ্রহ, বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংবলিত লিফলেট বিতরণ, উন্মুক্ত আলাপন, যৌক্তিক উপায় গ্রহণ এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করার জন্য `পলিসি অ্যাডভোকেসি` ও `ডোর টু ডোর` ক্যাম্পেইন শীর্ষক মিট দ্য প্রেসে তিনি একথা বলেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম বলেন, যারা আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ঘরে ফিরেছে তাদের ধন্যবাদ জানাই। প্রফেশনাল আন্দোলনকারীরা এখনও রাজপথে আছে। তারা ব্লকেড ব্লকেড খেলা খেলছে। ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল রাখার পরও তারা আন্দোলন করছে। ক্ষণে ক্ষণে কথা পাল্টাচ্ছে। দাবি পাল্টাচ্ছে। তারা কি চাকরিজীবী হতে চায় নাকি আন্দোলনজীবী হতে চায়? সেটা জানতে হবে।
এটা (কোটা সংস্কার) স্পট ডিসিশনের কোনো ব্যাপার না। এর একটা নিয়ম আছে। আজ যারা নিজেদের মেধাবী দাবি করছে তারা কি বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ সম্পর্কে জানে?
কোটার বিষয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে সাদ্দাম বলেন, নারীদের সামনে আনতে তাদের কোনো কথা নেই। ২০১৮ এর পর কোটা না থাকায় নারীদের অংশগ্রহণ কমেছে। কমেছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংখ্যাও। বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ চাকরিই পায়নি। তাছাড়া ২০১৮ সালে আন্দোলনকারীদের একজনও বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অবজ্ঞা করে কোনো কিছু করতে দেয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাদের এত এলার্জি- এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের কাঁধে ভর করে একটি কুচক্রি মহল দেশের উন্নয়ন বিঘ্নিত করার অপচেষ্টা করছে- অভিযোগ করে ইনান বলেন, এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে একটি মহল ষড়যন্ত্র করে স্মার্ট বাংলাদেশের যাত্রাকে বিঘ্ন ঘটানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। কোটা আন্দোলনের নাম নিয়ে যদি কেউ শান্ত পরিবেশকে অশান্ত কার চেষ্টা করে তার পরিণতি ভালো হবে না।
তিনি বলেন, নারী কোটা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি আস্ফালন করতে চাইছে। নারী কোটার সুবিধা সব নারীদের জন্যই প্রযোজ্য। জেলা কোটার সুবিধা কি নির্দিষ্টি জেলার মানুষ সুবিধা পাবেন? না, যে সব জেলা পিছিয়ে আছে তাদের এগিয়ে আনার জন্যই এই জেলা কোটা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ভুল করছেন বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। কোটা আন্দোলন এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ১৬ জুলাই বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েনি। শিক্ষার্থীরা যেন ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের লিপ্ত না হয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিহার করে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক কিছু করলে, ভাঙচুর করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘আমি মনে করি শিক্ষার্থীরা সরে যাবে। রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন ঠিক হচ্ছে না। কোটা নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে মতভেদ থাকতেই পারে। কেউ কাউকে কষ্ট না দিয়ে তাদের দাবি জানাবে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ত্যাগ করে আদালতে যেতে পারে বা যোগাযোগ করতে পারে।’
ছাত্র আন্দোলন হবে তাদের একাডেমিক সুবিধার জন্য। কিন্তু এদেশে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সাধারণ জনগণ চায় আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান।
লেখক : শাহ আলম ডাকুয়া, সংবাদকর্মী ও ছড়াকার
আপনার মতামত লিখুন :