দেশে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ডেঙ্গু। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ। মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এতে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮১৯ জনে। এসময় নতুন করে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে চলতি বছরে মশাবাহিত রোগটিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০২ জনে। ৫৩৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার ১৯৯ জন রয়েছেন। এছাড়া ঢাকা বিভাগে ৯০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৩ জন, খুলনায় ৫৯ জন, ময়মনসিংহে ১৭ জন ও বরিশালে ৩৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট ১৬ হাজার ৮১৯ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ নারী।১ জানুয়ারি থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত ১০২ জনের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী এবং ৪৮ শতাংশ পুরুষ।
* উপসর্গ : জ্বরই প্রধান উপসর্গ। চামড়ায় দানা (র্যাশ), রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে কারও কারও।
* জ্বর : অন্য ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুজ্বর সাতদিনের বেশি থাকে না। প্রথমদিকে একটানা উচ্চ তাপমাত্রায় থেকে ছয়দিনের পর জ্বর চলে যেতে পারে। দুদিন পর একদিন জ্বর না থেকে আবার দুদিনের জ্বর থাকল তারপর জ্বর চলে গেল তাও হতে পারে।
* অন্যান্য উপসর্গ : সব জ্বরে, বিশেষত ভাইরাস জ্বরে গা ম্যাজ ম্যাজ করে ব্যথা হয়। ডেঙ্গুতে ব্যথা বেশি হয়। অনেকের এত বেশি ব্যথা হয় যে, তারা হাড় ভাঙার সঙ্গে তুলনা করেন। এ ছাড়া রোগীর চোখের পেছনেও ব্যথা অনুভূত হয়।
* রক্তক্ষরণ : চামড়ায়, মুখে, খাদ্যনালিতে, চোখে হতে পারে। তবে বেশি যা হয় তা হলো মেয়েদের মাসিক একবার হয়ে গেলেও একই মাসে আবার মাসিক হয়।
* দানা (র্যাশ) : ডেঙ্গুর টিপিক্যাল র্যাশ বেরোয় জ্বরের ষষ্ঠ দিনে। তখন জ্বর থাকে না। দেখলেই চেনা যায়, খুঁজতে হয় না। এ ছাড়া জ্বরের প্রথমে গায়ে চাপ দিলে আঙ্গুলে ছাপ পড়ে। এটাকে তিনটা ফেইজে বলা হয়।
১. ফেব্রাইল ফেইজে জ্বর ও জ্বরের উপসর্গ থাকে।
২. এফেব্রাইল ফেইজে জ্বর চলে যায়। তবে এটাকে ক্রিটিক্যাল ফেসও বলে। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের স্টেজটা মারাত্মক জটিল হয়। এটা দুইদিন থাকে। জ্বর না থাকলেও এ সময় সতর্ক থাকতে হয়।
৩. কনভালেসেন্ট ফেইজে অধিকংশ সেরে উঠলেও কেউ কেউ ভীষণ দুর্বল হয়। বিষণ্নতায় ভোগেন।
> ডেঙ্গু দুই ধরনের—
ক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার : আর দশটা ভাইরাল ফিভারের মতো ভয় না পেলে কোনো সমস্যা নেই।
খ. ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার : ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সবকিছুই থাকে। রক্তনালির লিকিং হয় বলে বাড়তি কিছু সমস্যা হয়। জ্বরের সঙ্গে যদি প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হয় এবং হিমাটক্রিট ২০% ভেরিয়েশন হয় তবে সেটা ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের চারটি গ্রেড রয়েছে।
গ্রেড-১ : টুনিকেট টেস্ট পজিটিভ হওয়া ছাড়া রক্তক্ষরণের আর কোনো আলামত থাকে না।
গ্রেড-২ : দৃশ্যত, রক্তক্ষরণ থাকে।
গ্রেড-৩ : ১ বা ২ এর সঙ্গে যদি ব্লাড প্রেশার কমে, পালস বাড়ে।
গ্রেড-৪ : ১ বা ২ এর সাথে যদি ব্লাড প্রেশার, পালস রেকর্ড না করা যায় গ্রেড ৩ ও ৪-কে একসঙ্গে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলে।
* ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : খুব টক্সিক না হলে কোনো জ্বরেরই তিনদিন আগে কোনো পরীক্ষার দরকার নেই। টিসি ডিসি হিমোগ্লোবিন ইএসআর, এসজিপিটি : ভাইরাল ফিভারে কাউন্ট বাড়ে না। যদি কাউন্ট কমে, বিশেষ করে টিসি তিন হাজারের নিচে নামে তাহলে ডেঙ্গু নিশ্চিত।
এনএস ১ জ্যান্টিজেন : এটাই জ্বরের প্রথম সপ্তাহের পরীক্ষা। জ্বর থাকাকালীন পজিটিভ হয়।
* অ্যান্টিবডি পরীক্ষা : সাত দিন পর পজিটিভ হয় বলে এটা কার্যকরী নয়। এনএস ১ অ্যান্টিজেন করা গেলে এটার দরকার ও নেই।
* প্লাটিলেট কাউন্ট ও হিমাটোক্রিট : প্লাটিলেট আতঙ্ক না থাকলে অত্যাবশ্যকীয় নয়। হিমোরেজক ফিভার ডায়াগনোসিস ও ফলোআপের জন্য করা লাগে। হিমোরেজিক ফিভার হলে পেটে ও ফুসফুসে পানি নিশ্চিত করার জন্য পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও বুকের এক্স-রে করা লাগে।
* নিউট্রিশন : জ্বরের সময় ক্ষুধামন্দা হয়, বমি লাগে। এ সময় ফলের রস উপকারী। স্বাভাবিক খাবার খাওয়া যাবে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু এবং গ্রেড-১ হিমোরিজিকে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। গ্রেড-২ এ অতিরিক্ত সমস্যা হলো প্রথমে ধরতে না পারলে চিকিৎসা না দিলে গ্রেড-৩ বা গ্রেড-৪ অর্থাৎ শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে। পরিমিত পানি দিতে হবে জ্বর নামিয়ে রাখতে।
গ্রেড-২ তে যদি পেটের ব্যথা কমছে না, বমি হচ্ছে অথবা প্রেশার ঠিক থাকছে না তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।
* রক্ত দেওয়া (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) : রক্তক্ষরণ হলে নিয়ম হলো রক্তবদল করতে হয়। সিস্টলিক ব্লাড প্রেশার ১০০-এর নিচে নামলে, পালস ১০০-এর বেশি হলে। হিমোগ্লোবিন ১০-এর নিচে নামলে ও হিমাটোক্রিট কমে গেলে রক্ত দিতে হবে।
> প্রতিরোধ : মশা মারতে ঘরে স্প্রে ব্যবহার করুন। তা ছাড়া ফুল হাতা কাপড় এবং পা মোজা ব্যবহার করুন। দিনে মশারি দিয়ে ঘুমান। মশার ডিম থেকে লারভা হয়ে থাকে। তাই এই পাত্র মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে জলকান্দায়, নির্মাণ সামগ্রীর পানি, বৃষ্টিতে জমে থাকা রাস্তার এবং পাত্রের পানিতে স্প্রে করুন।
★ ডেঙ্গু জ্বর রোগীর জন্য ঘরোয়া পরামর্শ
* চিকেন ভেজিটেবল স্যুপ
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর জন্য উপাদেয় খাবার চিকেন ভেজিটেবল স্যুপ। সবজি হিসেবে ব্রোকলি, মটরশুঁটি, ক্যাপসিকাম এবং বিট যোগ করতে হবে। স্যুপ থেকে ভিটামিন বি১২, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন, জিংক, প্রোটিন ও ভিটামিন সি পাওয়া যায়। এই স্যুপ শরীরে তরল পদার্থের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি, অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করবে এবং শরীরে শক্তি জোগাবে। তবে স্যুপে মসলার ব্যবহার কমাতে হবে।
* টক দই
টক দই একদিকে আপনার শরীরে তরলের ভারসাম্য রক্ষা করবে, অন্যদিকে এটি প্রোবায়োটিক হিসেবে কাজ করে পরিপাকতন্ত্রের ক্ষমতা বাড়াবে। ফলে শরীরে পুষ্টির উপাদানের শোষণক্ষমতা বেড়ে যাবে। শরীর ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা পাবে।
* পেঁপের জুস
পেঁপের জুস ভিটামিন বি১২ এবং ফলিক অ্যাসিডের ভালো উৎস। এটি অণুচক্রিকা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অন্তত প্রতিদিন ৫০০ মিলিলিটার পেঁপের জুস খেতে হবে।
* ভাতের মাড়
ভিটামিন বি-এর উৎস হিসেবে ভাতের মাড় খুবই উপযোগী খাবার। এর সঙ্গে কিছু সেদ্ধ সবজি এবং একটু লেবুর রস যোগ করলে এর গুণাগুণ আরও বেড়ে যায়। ডেঙ্গু রোগীকে ভাতের মাড় খাওয়ালে শরীরে পুষ্টির চাহিদা মিটবে আবার তরলের ভারসাম্যও বজায় থাকবে।
* জাম্বুরার জুস
জাম্বুরা ভিটামিন সি ও পটাশিয়ামের বেশ ভালো উৎস। শরীরে প্লাজমার সঙ্গে পটাশিয়াম বের হয়ে যায়। এর ঘাটতি পূরণ করতে জাম্বুরার জুস অত্যন্ত কার্যকরী। সঙ্গে ভিটামিন এ, বি ও সি পাওয়া যায়।
* আনারের জুস
অস্থিমজ্জার কর্মক্ষমতা বাড়াতে আয়রন, ভিটামিন বি এবং ফসফরাসের প্রয়োজন হয়। সবগুলো উপাদান আছে আনারের জুসে। সঙ্গে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোলেট, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন কে। আনারের জুস অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি হিসেবে
কাজ করে।
* নরমাল স্যালাইন
প্যাকেটজাত ওরস্যালাইন সঠিক নিয়মে আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। এতে ইলেকট্রোলাইটসের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি তরলের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
* কচি ডাবের পানি
কচি ডাবের পানি সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও অন্যান্য ইলেকট্রোলাইটসের ভালো উৎস। এটিও ইলেকট্রোলাইটসের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি তরলের ভারসাম্য রক্ষা করে।
* কোন খাবার খাওয়া যাবে না
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর অতিরিক্ত মসলাদার খাবার ও ভাজাপোড়া খাওয়া যাবে না। এসব খাবার রোগীকে শকের দিকে নিয়ে যায়। এই খাবারগুলো হজমের জন্য অনেক পানির প্রয়োজন হয়। এ সময়ে শরীরে এমনিতেই পানির ঘাটতি থাকে। এর মধ্যে যদি খাবার হজম করতে অতিরিক্ত পানি প্রয়োজন হয়, তখন রক্তচাপ আরও কমে যেতে পারে, যা রোগীর জন্য বিপজ্জনক। তাই এসব খাবার একেবারেই খাওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে এখন মহা আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা গেছে। ২০২৩ সালে সারাদেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৮৬৮ জন। আর ২০২৩ সালেই মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন, যা বিগত দুই দশকের মোট মৃত্যুর প্রায় দ্বিগুণ।
এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাত, জলাবদ্ধতা ও বাতাসে অত্যধিক আর্দ্রতা এ মশার বংশ বিস্তারে সহায়ক।আর মশার প্রজনন স্থানগুলো ধ্বংস করাসহ হটস্পটগুলোতে উড়ন্ত মশা মারার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গুর জন্য উচ্চঝুঁকি থেকেই যাবে।
পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দ্রব্যাদি, গাড়ির চাকার টায়ার, বাড়ির পানি সংগ্রহের ট্যাংক, ফুলের টব ও ফুলদানিতে জমে থাকা পানিতে এ মশা বংশ বিস্তার করে। এদের ডিম ফোটার জন্য পানির প্রয়োজন হয় বলে শুকনো মৌসুমে এ মশা কমে যায়। তাই বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। আর বর্ষাকালে যেমন মানুষ অতিরিক্ত গরম থেকে মুক্তি পায় তেমনি অনেক ধরনের রোগবালাইও মোকাবিলাও করতে হয়। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার, কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যাবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
লেখক :
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
কলাম লেখক ও গবেষক
ইমেইল,[email protected]
মোবা.০১৮২২৮৬৯৩৮৯
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :