বনরুই প্রাণিকূলে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণি।পিঁপড়াজাতীয় প্রাণী খায় বলে আঁশযুক্ত পিঁপড়াভুক নামেও পরিচিত। তবে অনেক উপজাতিরা একে রুহিন করে ডাকে। সারা শরীরে মাছের মতো আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম। স্বভাবেও অতি অদ্ভুত। কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, লম্বা লেজ গাছের ডালে জড়িয়ে ঝুলেও থাকতে পারে। বিপদ বুঝলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরো দেহ ঢেকে বলের মতো করে নেয়। একবার সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণিও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এ নিরীহ প্রাণিটি শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে।
বনরুইকে বলা হয় আঁঁশযুক্ত পিঁপড়াভোজী প্রাণী। ফোলিডোটা বর্গের যে আট প্রজাতির বর্ম-ঢাকা, দন্তহীন স্তন্যপায়ীর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে রয়েছে বনরুই তার একটি। বনরুইয়ের ইংরেজি প্রতিশব্দ পাঙ্গোলিন্স। মালয় ভাষায় যার অর্থ দাঁড়ায় ঘূর্ণায়মান বস্তু যা আত্মরক্ষার সময় প্রাণীটি নিজেকে বলের মতো কুঁকড়ে ফেলার অভ্যাসকে ইঙ্গিত করে। একটি পূর্ণবয়স্ক বনরুই লম্বায় সাধারণত ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার (১-৩ ফুট) এবং ৫ থেকে ২৭ কেজি (১০-৬০ পাউন্ড) ওজনের হয়। আর এদের লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার (প্রায় ১০-২৮ ইঞ্চি) অবধি হয়ে থাকে। মুখের দিক এবং শরীরের নীচের অংশ বাদে এদের সমস্ত শরীর সিমেন্টযুক্ত এক ধরনের চুলের সমন্বয়ে বাদামী আঁঁশ দিয়ে আচ্ছাদিত। নাক সরু ও চোখা। জিভ লম্বা ও আঠালো যা ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি) পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। নাকের মতো এদের চোখ ও কানও সরু। আশ্চর্যজনকভাবে বনরুইয়ের সামনের নখর পেছনের নখরের তুলনায় দ্বিগুণ লম্বা।
বনরুই প্রাণিকুলে একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। সারা শরীরে মাছের মতো আঁশের ফাঁকে ফাঁকে থাকে শক্ত লোম।কিছু বনরুই যেমন আফ্রিকান কালো-পেটযুক্ত ম্যানিস লংগাইডাটা ও চীনা এম. পেন্টাড্যাকটায়লা বৃক্ষবাসী এবং আফ্রিকার বৃহদাকার স্থলচর বনরুই এম. জিগান্তেয়াকে স্থলচর হিসেবে দেখা যায়। বাকি বনরুইদের সকলেই নিশাচর। দিনের বেলায় যেমন গর্তে বাস করে। একইভাবে এরা কিছুটা সাঁতার কাটতে সক্ষম। উইপোকা বনরুইয়ের প্রিয় খাবার হলেও পিঁপড়া এবং অন্যান্য পোকামাকড়ও এরা ভক্ষণ করে। গন্ধ শুকে শিকার সনাক্ত করা এই প্রাণীটির সহজাত স্বভাব।আপৎকালীন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষার মাধ্যম হিসেবে মলদ্বার গ্রন্থি থেকে এক ধরনের তরল দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থ নিঃসরণ করার পাশাপাশি শরীরকে কুঁকড়ে গোলাকার বলের মতো আকৃতি করে গড়িয়ে চলার প্রবণতা এদের মধ্যে লক্ষ্যণীয়, যা শিকারীর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সাধারণত প্রাণী হিসেবে বনরুই খুবই ভীতু স্বভাবের। এরা একা বা জোড়ায় বাস করে।
বেশিরভাগ প্রজাতিতে প্রতি প্রসবে কেবলমাত্র একটি যুবক জন্মগ্রহণ করে, তবে কিছু এশিয়ান প্রজাতিতে দুটি বা তিনটি পুরুষ সন্তান জন্ম নেওয়ার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। জন্মের সময় অল্প বয়স্ক বনরুইয়ের দেহাবরণ অত্যন্ত নরম থাকে এবং কিছু সময়ের জন্য মা বনরুইয়ের পিঠে চালিত হয়। যদিও এদের গড় আয়ু নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। তবে বন্দী অবস্থায় পর্যবেক্ষণকালে ২০ বছর পর্যন্ত এদের বাঁচতে দেখা গেছে।বনরুইয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ত্বক ও আঁঁশ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ওষুধ তৈরির অন্যতম কাঁচামাল এবং অত্যধিক মূল্যবান হওয়ায় এদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়।
স্বভাবেও অতি অদ্ভুত। কুঁজো হয়ে দুলতে দুলতে চলে, লম্বা লেজ গাছের ডালে জড়িয়ে ঝুলেও থাকতে পারে। বিপদ বুঝলে সামনের দুই পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে লেজ দিয়ে পুরোদেহ ঢেকে বলের মতো করে নেয়। একবার সামনের পা দিয়ে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে পারলে শক্তিশালী প্রাণীও সহজে এদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আর এভাবেই এ নিরীহ প্রাণীটি শত্রম্নর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে থাকে।সারাদিন গর্তে ঘুমিয়ে কাটায় আর রাতে খাবারের খোঁজে বের হয়ে মাটি শুঁকতে থাকে। পিঁপড়ার বাসা বা উঁইপোকার ঢিবির খোঁজ পেলে শক্তিশালী নখের থাবা দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে ফেলে। এরা মাটির নিচে প্রায় ছয় মিটার গর্ত করে বাসা বাঁধে। শীতকাল প্রজনন মৌসুম। সাধারণত একটি বা দুইটি বাচ্চা দেয়। বিশ্বে ৮ প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে।
তারমধ্যে বাংলাদেশে মালয়, ভারতীয় ও চায়না বনরুই ছিল। এমন ধারণা থাকলেও বর্তমানে চায়না বনরুই ছাড়া অন্য প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মিলছে না। কেননা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে বনরুই।
এর ইংরেজি নাম ‘Pangolin’। চায়না বনরুইয়ের বৈজ্ঞানিক নাম ‘Manis pentadactyla’। দাঁত নেই বলে আগে দন্তহীন স্তন্যপায়ী প্রাণির দলে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডাটার (Pholidata) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার সদস্য একমাত্র বনরুই। তবে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদের আলাদা একটি দল ফোলিডাটার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার সদস্য একমাত্র বনরুই।
গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং মৌলভীবাজারের বিভিন্ন বনে চায়না প্রজাতির বনরুইয়ের দেখা মেলে। তবে তা বর্তমানে বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে। মহাবিপন্ন হিসেবে আছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ পরিষদ (আইইউসিএন)। অবাধ শিকার, পাচার, বাসস্থান নষ্টের কারণে এখন তারা মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত। বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী পাচার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা `ট্রাফিক`র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য।ট্রাফিক`র সূত্রমতে, ২০১০-১৫ সালের মধ্যে বনরুই পাচারে ব্যবহৃত মোট ১৫৯টি `রুট` পাওয়া গেছে। বনরুইয়ের এক কেজি মাংস ৩৫০-৫০০ ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়। চায়না এবং ভিয়েতনামে এর প্রচুর চাহিদা।
প্রতি বছর বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, চায়না, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ টন বনরুই পাচার হয়। এশিয়ায় এ প্রজাতি বর্তমানে অতি মহাবিপন্ন। একসময় চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগে নিয়মিত এদের দেখা মিললেও বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বনরুই হারিয়ে গেছে। আদিবাসী গোষ্ঠীদের শিকার এবং পার্বত্য এলাকা থেকে মিয়ানমার হয়ে চীনে মাংস হিসেবে বনরুই পাচার করার কারণে বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে আর এদের দেখা মেলে না। স্থানীয়দের ভাষায়, এরা এখন বিলুপ্ত।
প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ` গবেষণার তথ্যমতে, ২০১৫-১৮ সাল পর্যন্ত একটানা ৪ বছর পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং করে ১৯ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রাণী দেখা গেলেও কোনো বনরুইয়ের দেখা মেলেনি।প্যাঙ্গলিন ডিস্ট্রিবিউশন অ্যান্ড কনজার্ভেশন ইন বাংলাদেশ`র সহকারী গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন জানান, বাংলাদেশে মোট ১১টি সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চলে বনরুইয়ের ওপর জরিপ করা হয় ২০১৭ সালে। আশার কথা হলো, ১১টি বনাঞ্চলের মধ্যে ৮টিতেই পাওয়া গেছে বনরুইয়ের অস্তিত্ব। আশঙ্কার কথা হলো, এসব বনাঞ্চলে একইসাথে মিলেছে বনরুই শিকারের আলামত।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত বনরুইয়ের মাংস ও আঁশের জন্য এটি শিকার করা হয়ে থাকে।সবশেষ আইইউসিএন`র লাল তালিকা অনুসারে বিশ্বব্যাপী চায়না বনরুইকে `মহাবিপন্ন` ও ভারতীয় বনরুইকে `বিপন্ন` হিসেবে ঘোষণা করেছে। এছাড়া ২০১৫ সালে প্রকাশিত আইইউসিএন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত `রেড লিস্ট অব বাংলাদেশ` উভয় প্রাণীকে বাংলাদেশের জন্য `মহাবিপন্ন` হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যা বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়ার শেষ সংকেত। তাই এখনই সংরক্ষণের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে প্রাণীটি যেমন অজানা থেকে যাবে; তেমনি বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে সুন্দর আরও একটি বন্যপ্রাণী।
ইতোমধ্যে হায়েনা, শোল, নীলগাইসহ অনেক প্রাণী বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মোঃ ছানাউল্যা পাটওয়ারী বলেন, `বনরুই পাচারকারীরা সক্রিয় রয়েছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবছর ৪টি বনরুই আমরা উদ্ধার করেছি।
সেইসাথে বনরুই নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণের জন্য ইতোমধ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা প্রস্তাব আকারে আছে।`তিনি আরও বলেন, `যেসব এলাকায় বনরুই আছে; সেসব এলাকায় জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।`দেশের পূর্ব ও উত্তরের জেলাগুলির পত্রঝরা শালবন বা মিশ্র-চিরসবুজ বনে এদের বাস। অনেকে বনরুইয়ের মাংস খায়। বাসস্থান ধ্বংসের জন্যই এরা মূলত বিপন্ন। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায়ও বনরুই আছে। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বনরুইয়ের মধ্যে আছে Indian Pangolin/Scaly Anteater (Manis crassicaudata), Malayan Pangolin (Manis javanica) ও Chinese Pangolin (Manis pentadactyla)।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :