মানব সংস্কৃতির উন্মেষ এবং ক্রমবিকাশের সঙ্গে নদী প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ও বৃহৎ সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশের বুক চিরে ছোট বড় প্রায় ৭০০-র মতো নদ-নদী বয়ে গেছে। একসময় নদীই ছিল যোগাযোগের প্রধান পথ। কৃষিকাজের সেচের একটি প্রধান উত্স হিসেবে কাজ করে আসছে বহুকাল থেকেই। বাংলাদেশের এত উর্বর মাটি সৃষ্টির পেছনে প্রধান কারিগর হিসেবে পলিমাটির জোগান দিয়েছে এই নদীগুলোই। ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রা উচ্চ রাখতে ভূমিকা রেখেছে নদীগুলো—যা গৃহস্থলি, খাবার, কৃষিকাজ ও শিল্প কারখানার কাজসহ অন্যান্য কাজের প্রধান সহায়ক। সামুদ্রিক অনেক মাছ প্রজননের সময় নদীতে এসেই ডিম পাড়ে বংশ রক্ষার জন্য।
বাংলাদেশের নদ-নদী রক্ষার জন্য নদ-নদী নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর সাথে সাথে সচেতন সমাজ যতই নদী রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখছে এবং সরকারি সংস্থাগুলো নদী বেদখলমুক্ত করতে যতই অভিযান পরিচালনা করছে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদী দখলের ঘটনা। নদীর এক স্থানে উদ্ধার অভিযান চলছে তো অন্য স্থান নতুন করে বেদখল হয়ে যাচ্ছে। একদিকে ব্যাপক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হচ্ছে, কয়েকদিন যেতে না যেতেই তা আবারও দখল হয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীসহ ঢাকার চারপাশের নদনদীগুলো দখলে-দূষণে মৃতপ্রায়। অব্যাহত দখলবাজি ও ভরাটের কারণে নদীর প্রশস্ততা ও পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে কোথাও কোথাও সংকীর্ণ খালে রূপ নিয়েছে। যথেচ্ছ স্থাপনা নির্মাণ, নদীতে সরাসরি শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার কারণে এসব নদীর পানি ইতোমধ্যেই তার উপযোগিতা হারিয়েছে।নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলার বুক চিরে ছোট-বড় অসংখ্য নদ-নদী প্রবাহিত হয়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যা আমাদের দেশের সৌন্দর্যকে বাড়িয়েছে বহুগুণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ নদনদীগুলোতে নেই তাদের হারানো যৌবন, নেই সেই আগের মতো স্রোত বা পানিপ্রবাহ। নদীগুলো আজ বিপজ্জনকভাবে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ফলস্বরূপ ক্রমাগত অস্তিত্ব হারিয়ে উষ্ণ মরূকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে আমাদের দেশ, যা আমাদের দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির জন্য চরম হুমকি। তাই নদীসমূহের অস্তিত্ব রক্ষা জরুরি।রাজধানীর গন্ডি পেরিয়ে আশপাশে, বিভাগীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সব নদ-নদীতেই দখলবাজি চলছে। নদী উদ্ধার ও সংরক্ষণে কার্যকর কোনো স্থায়ী পদক্ষেপও খুব একটা পরিলক্ষিত হয়না।
চলতি বছরের শুরুতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সারা দেশে জেলা প্রশাসকদের কাছে নদী দখলের সঙ্গে জড়িতদের নামের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল। জেলা প্রশাসকদের পাঠানোর তালিকার সূত্র ধরে সারা দেশের নদী দখলদারদের নামের তালিকা বা সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, সারা দেশে নদী দখলদারের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৭৪২ জন। তবে এ কথা ঠিক যে, কথিত তালিকার সব দখলদারের অবস্থান সমান নয়। কেউ কেউ নদীভাঙনের শিকার হয়ে নদী তীরে হয়তো নিজের বসতবাড়ি গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে। নদীর স্বাভাবিক সীমানা বিকৃত বা পরিবর্তন ঘটে, গতিশীলতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং দূষণ ঘটায় এমন যেকোনো কর্মকান্ড দখলবাজি হিসেবে গণ্য হবে। তবে নদীতে বেড়া দিয়ে ভরাট করে অথবা কংক্রিটের পিলারের ওপর স্থাপনা বা কল-কারখানা নির্মাণকারীরাই হচ্ছে প্রকৃত ভূমিদস্যু ও দখলবাজ। ঢাকার জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে ঢাকার চারপাশের ৫টি নদীতে ৯৫৯ জন দখলদারের নামের তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে। তালিকায় সকল দখলবাজদের পরিচয় প্রকাশ করা সমীচীন বলে মনে করে সুশীল সমাজ। ইতোমধ্যে সরকার দেশের নদ-নদী, খাল-বিল উদ্ধারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেই লক্ষ্যে দখলদারদের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে, এই অভিযানের পাশাপাশি আমরা চাই জবাবদিহিতা ও বিচারের পালা। আইনের ফাঁক-ফোকর বা দীর্ঘসূত্রতার জেরে এরা যেন পার পেয়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। এক শ্রেণির মানুষ দশকের পর দশক ধরে নদ-নদী ও সরকারি জমি দখল করে ভোগদখল করে এলেও কোনো জবাবদিহিতা বা বিচারের সম্মুখীন না হওয়ায় সারা দেশে দখলদারের সংখ্যা বেড়েছে। এখন দখল উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকৃত জমির সংরক্ষণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। নদীর সীমানা সুনির্দিষ্টকরণ এবং তীর সংরক্ষণ, সবুজ বেষ্টনি ও ওয়াকওয়ে গড়ে তোলার পাশাপাশি জনকল্যাণে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে হবে।নদীতে কল-কারখানার বর্জ্য ফেলা এবং অননুমোদিত ও বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাবিহীন কল-কারখানা উচ্ছেদ করতে হবে। যাদের অবহেলা বা যোগসাজশে নদনদী দখল হয়েছে, তাদেরকেও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
নদীগুলোর অস্তিত্ব হারানো বা সংকটের পেছনে প্রধানত দুটি কারণ দায়ী; প্রথমত, ভূমিদস্যুদের দ্বারা নদী ভরাটকরণ ও স্থাপনা তৈরি। দ্বিতীয়ত, বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যের অব্যবস্থাপনার জন্য নদীদূষণ। এ ছাড়া সরকারের নজরদারির অভাব, ত্রুটিপূর্ণ নদীশাসন, উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার ইত্যাদি তো রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদনদীর উৎপত্তিস্থল ভারত। বাংলাদেশে ভারতের এই অভিন্ন নদনদীর সংখ্যা ৫৪ টি। ভারত এসব নদনদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে। ফলে দেশের অধিকাংশ নদীগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়। যার প্রভাবে প্রতি বছর নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া ভূমিদস্যু কর্তৃক নদী দখল, নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, অতিমাত্রায় পলিথিন দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে নদীর পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্ন হচ্ছে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা দেশের বেশিরভাগ অপরিকল্পিত নগরায়ণ, কলকারখানা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর সঠিক তদারকির অভাবে নদীতে অবাধে মিশছে রাসায়নিক পদার্থ ও ক্ষতিকর দ্রব্যাদি। যার কারণে নদীদূষণ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আর এই দূষণের প্রভাবে নদীর জলরাশির বিশাল জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন।
গবেষণায় দেখে গেছে, ঢাকার চারদিকের নদীগুলোতে প্রতিদিন ৪,৫০০ টন বর্জ্য ও ৫৭ লাখ গ্যালন ব্যবহৃত পানি জমা হয়। প্রতি বছর এসব বর্জ্য আবার অন্যান্য নদীতে গিয়ে মিশে যায়। উল্লিখিত কারণ বিশ্লেষণ করে গবেষকদের মতে, প্রতি বছর গড়ে ১০টি নদীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে দখল ও দূষণের কারণে বিলীন হয়ে গেছে ২৫টি নদী। বর্তমানে বিপন্ন নদীর সংখ্যা ১৭৪টি। গবেষণায় উঠে এসেছে, বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের দেশে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার নদীপথ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথচ নদীপথ বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। ফলে সড়কপথের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে, জ্বালানি তেলের ব্যবহার ও তার আমদানিও বাড়ছে বহুল পরিমাণে। নদী গবেষকরা বলছেন, ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। অবশিষ্ট এসব নদীর অস্তিত্বও আজ হুমকির মুখে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর এবং কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির প্রাণশক্তি হলো নদনদী। এজন্যই আমাদের দেশের ভূমি যথেষ্ট উর্বর। দেশের শতকরা ৮০% মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু নদীগুলোই যদি শুকিয়ে যায় কিংবা অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যায় তাহলে সমগ্র কৃষি ব্যবস্থা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে যা হবে আমাদের সামগ্রিক অগ্রগতির পথে মূল অন্তরায়। অন্যদিকে দেশের মৎস্য খাত আমাদের বিপুল জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা পূরণ করে এবং একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়, যার পুরোটাই আসে নদ-নদীগুলো থেকে। যদি নদীগুলো এভাবে বিলীন হয়ে যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি ও মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া পাখিসহ অনেক বন্যপ্রাণী নদীর ওপর নির্ভরশীল বিধায় এদেরও বিলুপ্তির সম্ভাবনা আছে। কমবে পদ্মার মোহনায় ইলিশ মাছের প্রজনন। কমে যাবে গবাদি পশু। যার প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্যে।
উল্লেখ্য, নদীর প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের আয়ের অন্যতম একটি উৎস। তা ছাড়া বর্তমানে দেশে অস্তিত্বমান নদ-নদীগুলোর পানির গুণগত মান কেমন তা পরীক্ষা করে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী হেলিয়নে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায় দেশের ৩২টি নদীতে নানা মাত্রায় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ভারী ধাতু পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগই ধারণ করে বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো, যা আমাদের জন্য অশনিসংকেত। স্বভাবতই নদী শুকিয়ে যাওয়া অর্থাৎ মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের নোনাপানি ঢুকবে ভেতরে, যদিও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যার ফলে মাটি ও গুণগত মান হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়বে, যা হবে কৃষকদের জন্য ভয়াবহ হুমকি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের দেশ একসময় মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং প্রকৃতির ওপর তা বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
নদীর বিপন্ন বা বিলুপ্ত হওয়ার খবরে আমরা ব্যথিত হই, কিন্তু নদী রক্ষার ব্যাপারে আমরা কেবল নীরবতাই পালন করে থাকি। কিন্তু এমতাবস্থায় জলজ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় এবং বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে নদীরক্ষার বিকল্প কিছু নেই। ইতোমধ্যে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন দেশের ৪৮টি নদীর প্রাণ ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের ১৭টি সুপারিশ দ্রুত বাস্তবয়ন করা। এদিকে ভারতের সাথে পানিবণ্টন চুক্তির সুরাহা করা অত্যান্ত জরুরি। নদীর তীরবর্তী অবকাঠামো নির্মাণ, দখলদারিত্ব ও নদী ভরাটকরণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য অপসারণ, বাসাবাড়ির নর্দমা ভরাট, রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ ইত্যাদি গর্হিত অপরাধের বিরুদ্ধে নদীশাসন আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। উপরন্তু নদীগুলোর সুষ্ঠু পরিকল্পিনামাফিক খননকাজ ও গভীরতা বাড়াতে হবে। নদীতীরে টেকসই বেরিবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া বিজ্ঞাপন, টিভি চ্যানেল, সেমিনার, মিডিয়ার মাধ্যমে নদী রক্ষাবিষয়ক ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সর্বোপরি নদীর অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন হতে হবে।
হৃদয় দেবনাথ: প্রকৃতি পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক লেখক ও সাংবাদিক
রিপোর্টার : গাজী টেলিভিশন
আপনার মতামত লিখুন :