বাংলাদেশ একটি গতিশীল ও দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদা লাভ করেছে। নতুন করে সরকারে এলে সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে আরও পদক্ষেপ নেবে দলটি, যার মধ্যে থাকবে উচ্চ আয়, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। আর সেটি বাস্তবায়নে তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কর্মপরিকল্পনা নেবে আওয়ামী লীগ।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগান নিয়ে ইশতেহার ঘোষণা করছে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক হোটেল সোনারগাঁওয়ে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা বেলা ১১টার কিছু পর থেকে ইশতেহার ঘোষণা শুরু করেন। ইশতেহারে শুধু পাঁচ বছর নয়, ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার কথাও বলা হচ্ছে।
এতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের আর্থসামজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সংবিধান ও বঙ্গবন্ধুর সমাজ উন্নয়ন দর্শনেরই প্রতিফলন। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ একটি গতিশীল ও দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদা লাভ করেছে। জাতীয় আয়ের মানদণ্ডে বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম অর্থনীতির দেশ। এ সময় দেশের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একটি বৃহৎ অভ্যন্তরীণ ভোক্তাবাজার সৃষ্টি হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। মূলত সরকারের ধারাবাহিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখে চলছে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিগত ১৫ বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ অর্জিত হয়। ২০২০-২১ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড অতিমারি বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, কোভিড-১৯ চ্যালেঞ্জ এবং চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা ও যুদ্ধাবস্থা, বিশ্ব অর্থনীতির শ্লথগতি ও মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের দেশজ আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে (৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ), যা অর্থনীতির সহনশীলতা ও সক্ষমতার পরিচায়ক। পরবর্তী বছরগুলোতেও বাংলাদেশ কমবেশি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়। ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশজ আয় ১১ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে অর্থনৈতিক কাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটেছে। জাতীয় আয়ে কৃষির অবদান প্রায় ১১ শতাংশ, শিল্পের ৩৮ শতাংশ এবং সেবা ৫০ শতাংশ হয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাংলাদেশ এখন কৃষিপণ্য রফতানি করছে।
অপরদিকে মূল্যস্ফীতি সর্বসাধারণের জন্য সহনীয় মাত্রায় রাখার ব্যাপারে সরকার সবসময়ই সজাগ ছিল, যা অর্থবছর ২১ বা পূর্ববর্তী পাঁচ বছর মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে ছিল। বিশ্বব্যাপী মন্দার অভিঘাতে ডলারের মূল্য বেড়েছে; যার ফলে আমদানি করা পণ্য-গম, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত গ্যাস (এলএনজি), সার, তুলা, ডাল, চিনি প্রভৃতি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাজারে চাপ সৃষ্টি করেছে। মুদ্রাস্ফীতি মানুষের সহনীয় পর্যায়ের বাইরে চলে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বমন্দার অভিঘাত মোকাবিলা, মুদ্রাফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জনদুর্ভোগ কমাতে বিলাসদ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করে, বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করা, প্রবাসী আয় দেশে পাঠাতে বিশেষ প্রণোদনা, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় এনে এবং প্রান্তিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সরবরাহের ব্যবস্থা করে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করেছেন।
সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে; ২০২১ সালে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি দিয়েছে। উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির গতিধারা থেকে সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশ উন্নয়ন, গণতন্ত্র, শান্তি ও সমৃদ্ধির মহাসড়কে অগ্রসরমান।
২০০৫-০৬ অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৩ গুণ বেড়ে হয়েছে ৫৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ১৫ বছরে রফতানি আয় গড়ে ১৬ শতাংশ হারে রফতানি বৃদ্ধি পায়। একই সময়কালে আমদানি ব্যয় প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পায়।
আমদানি ও রফতানি নিবন্ধনের মেয়াদ এক বছর থেকে পাঁচ বছরে উন্নীত করা হয়েছে এবং নিবন্ধন কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পাদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রফতানি উৎসাহিত ও বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নীতি সহায়তা ও প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে।
যৌথ মূলধনী কোম্পানির নামের ছাড়পত্র ও এনটিটি প্রোফাইল ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সম্পাদন করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত সমস্যাবলি সমাধানের জন্য সফটওয়ার চালু করা হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্প কারখানার পরিবেশ, শ্রম অধিকার, সুশাসন ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা সংক্রান্ত ৩২টি আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশন স্বাক্ষর/অনুস্বাক্ষর করা হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং রেমিট্যান্স প্রণোদনা দেয়ার ফলে বার্ষিক রেমিট্যান্স ২০০৫-০৬ সালের তুলনায় প্রায় ৪ দশমিক ৫ গুণ বৃদ্ধি পায়। রফতানি ও রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক উচ্চপ্রবাহের কারণে বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ অর্থবছর ২০০৫-০৬ এর ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে অর্থবছর ২০২০-২১ শেষে সর্বোচ্চ ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমে অর্থবছর ২০২২-২৩ শেষে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয় এবং অক্টোবর ২০২৩ শেষে ২৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়, যা দিয়ে প্রায় ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
মাথাপিছু আয় বর্তমানে উন্নীত হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ মার্কিন ডলারে, যা ২০০৫-০৬ সালে ছিল মাত্র ৪২৭ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি হয়েছে প্রায় ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা, যা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় জিডিপি এখন প্রায় ১০ গুণ।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে তা ছিল ৬১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এ সময়ে বাজেটের আকার বড় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ গুণ। বাজেট ঘাটতি আশানুরূপভাবে জিডিপির ৫ শতাংশে সীমিত রাখা হয়েছে গত ১০ বছর।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২০০৫-০৬ অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে ৯ গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশ, যা ২০০৫-০৬ এ ছিল ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারি বিনিয়োগ ২০০৫-০৬ সালের ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৬২ শতাংশ।
রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা হয়েছে, যার ফলে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে ক্রমবর্ধমান বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হচ্ছে। মোট রাজস্ব আয় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল ৪৪ হাজার ২০০ হাজার কোটি টাকা।
আয়বর্ধক কর্মসৃজন, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা সম্প্রসারণ, নতুন বেতন স্কেল ও ১০ শতাংশ বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি (মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় অতিরিক্ত ৫ শতাংশসহ) ইত্যাদি কার্যক্রমের ফলে মানুষের প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ২০০৯-১৮ সময়কালে বেতন ৩৪৩ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস (২০১৫-৩০) এবং ঋণাত্মক (২০২৫-৩০) হওয়ার ফলে সার্বিক জাতীয় আয়ের তুলনায় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার হবে উচ্চতর।
এবার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-কৌশল গ্রহণ করবে। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য হবে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, যা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্জিত হবে। আওয়ামী লীগ তরুণ ও যুবকদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কর্মপরিকল্পনা।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :