সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। ইসলাম ধর্মমতে, রোজা মুসলমানদের জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। বলা হয়েছে, ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা তৃতীয়।
ইসলামি শরিয়ামতে, সিয়ামের শুদ্ধতা ও যথার্থতার জন্য নির্ধারিত কিছু বিধিবিধান রয়েছে, যার ব্যতিক্রম ঘটলে রোজা ভঙ্গ হয়, অন্যথায় মাকরুহ হয়ে যায়। মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুমিন বান্দাকে রমজান মাসে ফরজ রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। যে ব্যক্তি রমজান মাসে রোজা রাখবে না বা ভঙ্গ করবে তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ ও সবল মুমিনের জন্য রোজা রাখা আবশ্যক। শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নামই রোজা নয়; বরং রোজা রাখা অবস্থায় মেনে চলতে হয় বেশ কিছু নিয়মও।
রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ-
? যে কারনে রোজা ভাঙ্গলে কাযা ও কাফফারা দিবে
? যে কারনে রোজা ভাঙ্গলে শুধু কাযা করতে হয়
? যে বিষয়গুলোর কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি–যেমনঃ
১নং- সহবাস; এতে লিপ্ত হলে সবচেয়ে বেশি গুনাহ হয়। যে ব্যক্তি রমযানের দিনের বেলা স্বেচ্ছায় স্ত্রী সহবাস করবে; এতে করে বীর্যপাত হোক কিংবা না হোক। তার উপর তওবা করা, কাযা ও কাফফারা করা উভয়টি জরুরি। এর দলিল হচ্ছে,
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট এসে বলল, আমি রোযা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে কাফফারা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী ৬৭০)
২নং- ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার। যেমনঃ পানি, ভাত, বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি।
এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাকে আদেশ করলেন, যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাটজন মিসকীনকে খানা খাওয়ায়। (সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১)
ইমাম যুহরী রহ. বলেন, ‘রমযানে রোযা রেখে যে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করবে তার হুকুম ইচ্ছাকৃতভাবে দিনে সহবাসকারীর অনুরূপ।’ অর্থাৎ তাকে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে। (মাবসূত, সারাখসী ৩/৭৩; আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৬)
#বিঃদ্রঃ সহবাসের মাধ্যমে বা ইচ্ছেকৃত খানা খেয়ে রোজা ভঙ্গ করলে, কাযা ও কাফফারা দিতে হয়। যেমনঃ
১) আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে।
২) বাকি দিন অর্থাৎ মাগরিব পর্যন্ত খানা না খেয়ে কাটাতে হবে।
৩) একটানা ৬০টি রোজা রাখতে হবে, যদি ফাঁক দিয়ে কোনদিন ১টা রোজা ছুটে যায়, তাহলে আবার প্রথম থেকে ৬০টি রোজা রাখতে হবে, অবশ্য নারীরা ঋতুর কারণে বিরতি দিতে পারবে।
আর ৬০টি রোজা রাখা সম্ভব না হলে, ৬০জন মিসকিনকে ১ বেলা খানা খাওয়াতে হবে।
যে বিষয়গুলোর কারণে শুধু কাযা করতে হয়। কাফফারা দেয়া লাগে না। যেমনঃ ১ রোজার বদলে শুধু ১টি রোজা কাযা করতে হয়।
৩নং- অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
সুফিয়ান সাওরী রহ. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক: ৭৩৮০)
৪নং- যা সাধারণত আহারযোগ্য নয় বা কোনো উপকারে আসে না, তা খেলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. ও ইকরিমা রহ. বলেন, ‘(পেটে) কোনো কিছু প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়। কোনো কিছু বের হওয়ার দ্বারা রোযা ভাঙ্গে না।’ (সহীহ বুখারী ১/২৬০)
৫নং- দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি তা থুথুর সাথে ভেতরে চলে যায় তবে রক্তের পরিমাণ থুথুর সমান বা বেশি হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৩; রদ্দুল মুহতার ২/৩৯৬)
৬নং- হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
৭নং- মেয়েদের লজ্জাস্থানের ভিতরে বা পুরুষ ও নারীর পায়খানার রাস্তার ভিতরে ভিজা আঙ্গুল প্রবেশ করায়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। শুকনো আঙ্গুল প্রবেশ করালে ভাঙ্গবে না।
৮নং- মুখে বমি চলে আসার পর ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেললে রোযা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা পরিমাণে অল্প হয়। (আলবাহরুর রায়েক ২/২৭৪; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪১৫)
৯নং- রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১০নং- পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
১১নং- নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি গলার ভেতরে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১২নং- মলদ্বারে/পায়খানার রাস্তার ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাযি. থেকে বর্ণিত-
শরীর থেকে (কোনো কিছু) বের হলে অযু করতে হয়, প্রবেশ করলে নয়। পক্ষান্তরে রোযা এর উল্টো। রোযার ক্ষেত্রে (কোনো কিছু শরীরে) প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়, বের হলে নয় (তবে বীর্যপাতের প্রসঙ্গটি ভিন্ন)। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪০২)
১৩নং- সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে।
১৪নং- ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার ২/৪০৫; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯১)
১৫নং- রোযা রাখা অবস্থায় ভুলবশত পানাহার করে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।
১৬নং- ভাঁপ দিয়ে গলার ভিতর ওষুধ পৌছালে, চাই আগের পদ্ধতিতে ভাঁপ দেয়া হোক বা নতুন কোন মেশিনের মাধ্যমে। রোজা ভেংগে যাবে।
১৭নং- মাথার এমন যখমে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে,যা দিয়ে ওষুধ মস্তিষ্কে চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন স্থানে ওষুধ লাগাতে হলে পরে সে রোযা কাযা করে নিতে হবে।
১৮নং- নাকে ড্রপ ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি খাদ্যনালিতে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।
১৯নং- আগর বাতি, কয়েল, হুক্কা, বিড়ি ইত্যাদির ধোঁয়া যদি কারো নাকের ভিতর প্রবেশ করে পেটে চলে যায়
২০নং- অনিচ্ছাকৃত বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে।
আলী ইবনে হানযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রোযার মাসে ওমর রাযি.-এর নিকট ছিলেন। তার নিকট পানীয় পেশ করা হল। উপস্থিত লোকদের কেউ কেউ সূর্য ডুবে গেছে ভেবে তা পান করে ফেলল। এরপর মুয়াযযিন আওয়াজ দিল, আমীরুল মুমিনীন! সূর্য এখনো ডুবেনি। তখন ওমর রাযি. বললেন, ‘যারা ইফতারি করে ফেলেছে তারা একটি রোযা কাযা করবে। আর যারা ইফতারি করেনি তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০)
২১নং- ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। হাদীস শরীফে এসেছে,مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ ، وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ রোযা অবস্থায় (অনিচ্ছাকৃত) বমি হলে কাযা করতে হয় না। আর ইচ্ছাকৃত বমি করলে সে যেন তা কাযা করে নেয়। (জামে তিরমিযী ৭২০)
২২নং- খাদ্যের বিকল্প হিসেবে ইনজেকশন পুশ করা।
কারণ এমন ইনজেকশন নিলে খাবার/পানাহারের প্রয়োজন হয় না। না খেয়েই দিন পার করা যায়।
তবে, যেসব ইনজেকশন পানাহারের স্থলাভিষিক্ত নয়; বরং চিকিৎসার জন্য দেয়া হয়, উদাহরণতঃ ইনসুলিন, পেনেসিলিন কিংবা শরীর চাঙ্গা করার জন্য দেয়া হয় কিংবা টীকা হিসেবে দেয়া হয় এগুলো রোযা ভঙ্গ করবে না; চাই এসব ইনজেকশন মাংশপেশীতে দেয়া হোক কিংবা শিরাতে দেয়া হোক। (শাইখ মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম এর ফতোয়াসমগ্র ৪/১৮৯) তবে, সাবধানতা স্বরূপ এসব ইনজেকশন রাতে নেয়া যেতে পারে।
২৩নং- ইনহেলার ব্যবহার করলে
শ্বাসকষ্ট দূর করার জন্য মুখের ভেতরে ইনহেলার স্প্রে করতে হয়। ওষুধটি যদিও স্প্রে করার সময় গ্যাসের মতো দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তা দেহবিশিষ্ট তরল ওষুধ। অতএব তরল ওষুধ মুখের ভেতর স্প্রে করার দ্বারা রোজা ভেঙে যাবে।
তবে মুখে স্প্রে করার পর না গিলে যদি থুতু দিয়ে ফেলে দেয়া হয়, তা হলে রোজা ভঙ্গ হবে না। এভাবে কাজ চললে বিষয়টি অতিসহজ হয়ে যাবে। এতে শ্বাসকষ্ট থেকে রেহাই পাওয়ার পাশাপাশি রোজা ভঙ্গ হবে না।
এবিষয়ে কিছু চিকিৎসকের মতামত হচ্ছে- সেহরিতে এক ডোজ ইনহেলার নেয়ার পর সাধারণত ইফতার পর্যন্ত আর ইনহেলার ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। তাই এভাবে ইনহেলার ব্যবহার করে রোজা রাখা যায়।
তবে কারও অবস্থা যদি এমন মারাত্মক আকার ধারণ করে যে, ইনহেলার নেয়া ব্যতীত ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে, তা হলে তাদের ক্ষেত্রে শরিয়তে এ সুযোগ রয়েছে যে, তারা প্রয়োজনভেদে ইনহেলার ব্যবহার করবে এবং পরবর্তী সময় রোজা কাজা করে নেবে।
আর কাজা করা সম্ভব না হলে ফিদিয়া আদায় করবে। আর যদি ইনহেলারের বিকল্প কোনো ইনজেকশন থাকে, তা হলে তখন ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা করবে। কেননা রোজা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোজা ভাঙবে না।
? উল্লেখ্য, বিনাওজরে ইচ্ছাকৃত পানাহার বা সহবাসের মাধ্যমে রমজানের রোজা ভেঙে ফেললে তার কাজা ও কাফফারা অর্থাৎ লাগাতার ষাট দিন রোজা রাখতে হয় বা ৬০ জন মিসকিন কে খাবার খাওয়াতে হয়।
পানাহার ও সহবাস ছাড়া অন্য পদ্ধতিতে ইচ্ছাকৃত ভাঙলে কাফফারা দিতে হয় না, হ্যাঁ কাযা অর্থাৎ এক রোজার পরিবর্তে এক রোজা আদায় করতে হয়। (মাবসুত সারাখসি ৩/৭২)
একুশে সংবাদ//এ.জে
আপনার মতামত লিখুন :