বেতন স্কেলের গ্রেড বা ধাপ ২০ থেকে কমিয়ে ১০টি করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে তিনি কথা বলেন।সরকার যদি এ কাজটি করতে পারেন, তাহলে সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেদের মধ্যে যে বৈষম্য, তা কমবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বেতন ধাপ ১০টিই ছিল। পরে তা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়। ২০১৫ সালে তা আরও দুই ধাপ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে বিভিন্ন ধাপের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য বেড়েছে। এ বৈষম্য কমানোর জন্য বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মচারীরা দাবি জানিয়ে আসছেন। সম্প্রতি বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ প্রণোদনা ভাতা দেওয়ার পর।
জাতীয় বেতন-কাঠামোর প্রথম ধাপে অর্থাৎ ১ নম্বর গ্রেডে বেতন-ভাতা পান সচিবরা। তাদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা। এ ধাপের ওপরও মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের জন্য একটি এবং সিনিয়র সচিবদের জন্য আরও একটি বিশেষ গ্রেড রয়েছে। আর শেষ অর্থাৎ ২০তম ধাপের মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা।
২০১৫ সালের বেতন স্কেলের আগে কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করার জন্য অর্থনীতিবিদ ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে বেতন ও চাকরি কমিশন গঠন করা হয়। পোশাকি নাম বেতন ও চাকরি কমিশন হলেও এটা পরিচিত ছিল ফরাসউদ্দিন কমিশন নামে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নরের সুপারিশে বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক বদল এনেছে সরকার। কিন্তু কর্মচারীবান্ধব হওয়ার পরও ফরাসউদ্দিনের কিছু সুপারিশ সরকার আমলে নেয়নি। এর মধ্যে বেতন স্কেল গ্রেড বা বেতনের ধাপ কমানো অন্যতম। কমিশন বেতনের ধাপ কমিয়ে ১৬টি করার সুপারিশ করেছিল। সুপারিশে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও প্রখর যুক্তি থাকার পরও সরকার তা পারেনি। বিশেষ করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বিরোধিতায় সরকার তা করতে পারেনি।
তিনি বলেন, বেতন ধাপ কমালে কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্য কমবে। সেই ভাবনা থেকেই ধাপ কমানোর সুপারিশ করেছিল কমিশন। সব সুপারিশ তো সরকার আমলে নিতে পারে না। সরকারকেও সব সামলে এগিয়ে যেতে হয়।
সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে জরিপ করেন। এতে বিভিন্ন শ্রেণির ছয় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশ নেন। তাদের মধ্যে মাত্র ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ বর্তমানে প্রচলিত ২০টি গ্রেডের পক্ষে। অবশিষ্ট ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রেড কামানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। ৫৯.৮২ শতাংশ কর্মচারী সর্বোচ্চ ১০টি স্কেল চান। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৭৩ শতাংশ কর্মচারী ১৫ থেকে ১৬টি গ্রেড চেয়েছেন।
তৃতীয় শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতির মহাসচিব মো. লুৎফর রহমান বলেন, বর্তমানে ১ ও ২০ নম্বর গ্রেডের বেতন অনুপাত ৯.৪৫:১। বাজারদরের কথা চিন্তা করলে এখানে বড় বৈষম্য। ১ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা আর ২০ নম্বর গ্রেডের পরিবারের সদস্য সংখ্যা সমান অর্থাৎ ছয়জন করে। সবাই একই বাজারে বাজার করে। সবাইকে একই দাম দিয়ে ডিম বা অন্যান্য জিনিস কিনতে হয়। এ জায়গা থেকে ২০ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীর বেতন দিয়ে চলা শুধু কঠিনই নয়, রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। যারা চাকরির বাইরে তাদের মধ্যে ব্যবসায়ীসহ একটা শ্রেণি পকেট থেকে টাকা বের করতে বাধ্য করে। আর যারা সরকারের উঁচু পদে চাকরি করেন, তাদের অনেক বেতন। তাদের তেল-লবণ-আটা কেনার চিন্তা করতে হয় না। সমস্যায় পড়েন ১৪ লাখ কর্মচারীর মধ্যে ১২ লাখ। অর্থাৎ সরকারের বেশিরভাগ কর্মচারী সংকটের মধ্যে। তাছাড়া কর্মকর্তাদের নানা ধরনের আয় রয়েছে। টেলিফোন ভাতা নগদায়ন করা হয়েছে, ডমেস্টিক এইড অ্যালাউন্সও একইভাবে পাচ্ছেন। এর বাইরে তাদের রয়েছে গাড়িসেবা নগদায়ন। এর আওতায় তারা গাড়ি কেনার জন্য বিনা সুদে ৩৫ লাখ টাকা ঋণ পাচ্ছেন। এই গাড়ি চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে পান ৫০ হাজার টাকা। কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে সুপারনিউমারি পদ। অর্থাৎ পদ খালি না থাকলেও তারা পদোন্নতি পান। আর আমাদের পদ শূন্য থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হয় না। চাকরিগত বৈষম্য কমবে যদি বেতন ধাপ কমানো হয়।
সচিবালয় কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ ও সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদ সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া মিলন বলেন, আমরা সর্বোচ্চ বেতন বৃদ্ধি ও সর্বনিম্ন বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি একটু বোঝার চেষ্টা করি। সর্বোচ্চ বেতন বৃদ্ধি হয়েছে ১ নম্বর গ্রেডের। ৪০ হাজার টাকা থেকে তাদের বেতন বেড়ে হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ তাদের বেতন বেড়েছে ৩৮ হাজার টাকা। আর ২০ গ্রেডের বেতন বেড়েছে (৮২৫০-৪১০০) ৪ হাজার ১৫০ টাকা। এ বেতন বাড়ানোর সময় তিতাসের গ্যাস বিল ছিল ৪৫০ টাকা। সেটা বাড়িয়ে প্রথম ৮৫০ ও সর্বশেষ ৯৭৫ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ গ্যাস বিল বেড়েছে (৯৭৫-৪৫০) ৫২৫ টাকা। ১ নম্বর গ্রেডের একজন কর্মকর্তার বেতন বৃদ্ধির তুলনায় গ্যাস বিল বেড়েছে ১.৩৮ শতাংশ। আর ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারীর বেতন বৃদ্ধির তুলনায় গ্যাস বিল বেড়েছে ১২.৬৫ শতাংশ। প্রায় একই হারে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, চিকিৎসা খরচ, বাজার খরচ বেড়েছে।
তিনি বলেন, ১৪ লাখ কর্মচারীর মধ্যে ১৩ লাখই বৈষম্যের শিকার। বাকি ১ লাখের জন্য ১৩ লাখকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি দুই শতাধিক স্কেলকে একত্রিত করে মাত্র ১০টি স্কেলে আনতে পারেন, তাহলে এখন সম্ভব নয় কেন? আমাদের এ বৈষম্যের জন্য আমলারা দায়ী। কর্মকর্তাদের বেতন বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কত বেশি? আগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে লেখাপড়ায় তফাত ছিল। এখন সেই পার্থক্য নেই। অনেক মন্ত্রণালয় আছে যেখানে সচিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন, সেই মন্ত্রণালয়ে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাও একই বিষয়ে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা সিনিয়র-জুনিয়র। আর চাকরিতে এসে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
বেতন ও চাকরি কমিশনের কাছে বেতন ধাপ ২০ থেকে কমিয়ে ১০টি করার দাবি করেছে প্রাথমিক শিক্ষা সরকারি কর্মচারী সমিতি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি সরকারি কর্মচারী সমিতি, চতুর্থ শ্রেণি অফিস সহায়ক সমিতিসহ বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন। তবে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ২০টি গ্রেড অক্ষুণœ রেখে সচিব, সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের জন্য অ্যাপেক্স স্কেল হিসেবে আলাদা স্কেল চেয়েছে। এ ছাড়া ক্যাডারভিত্তিক প্রথম শ্রেণির পদগুলোতে নন-ক্যাডারদের তুলনায় একধাপ উচ্চবেতন ব্যবস্থা করার সুপারিশ করে অ্যাডমিন ক্যাডারদের এই অ্যাসোসিয়েশন। কমিশন এসব প্রস্তাব আমলে না নিলেও সরকার ঘোষিত বেতন স্কেলে এগুলো বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণভাবে যদি স্কেল কম হয় তবে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন ব্যক্তির মধ্যকার যে বেতনের পার্থক্য রয়েছে, তার কিছুটা কমবেশি করা যাবে। তাও নির্ভর করবে গ্রেডগুলো কত টাকা থেকে শুরু হবে তার ওপর। শুধু ২০ থেকে ১০টি করলেই হবে না। গ্রেডগুলো কোনটাতে শুরু হবে আর কোনটাতে গিয়ে সর্বোচ্চ হবে, তার ওপরও নির্ভর করবে। তবে এটা দিয়ে সহজেই বৈষম্য নিরসন হবে এমন নয়। প্রথমত এ কার্যক্রম শুরু হলে একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।
একুশে সংবাদ/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :