- বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদ ছাড়া কোনো সংগঠন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না
- দোষীকে শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দেন শিক্ষকরা
- ‘জায়ামাত—শিবির—রাজাকার তাড়াতাড়ি বাংলা ছাড়’
বুয়েট নিয়ে রাজনীতি উৎতপ্ত। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও বুয়েটের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি অবস্থান। তাদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। গত বুধবার গভীর রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর প্রতিবাদসহ ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে নাটক বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন ছাত্রলীগ। গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ।
২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে এর প্রতিবাদে টানা দুদিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানান, বুধবার রাত দেড়টায় বুয়েটের মূল ফটক দিয়ে মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন ছাত্রলীগের অন্তত ৭০-৮০ জন নেতাকর্মী। সাদ্দাম হোসেনও সেখানে ছিলেন। তারা ক্যাফেটেরিয়ার সেমিনার কক্ষে বৈঠক করেন, সেখানে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। মোটরসাইকেল, গাড়ি নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে ক্যাম্পাসে `শোডাউন` করেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে ছাত্রলীগ নেতা ও বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রহিমের হল সিট বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গতকাল তাদের আনুষ্ঠানিক কোন কর্মসূচি ছিল না। তবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন অব্যাহত আছে। গতকাল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজরাজনীতির দাবিতে `কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে বুয়েট ক্যাম্পাসে যান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। জানা গেছে, বেলা আড়াইটারব দিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি`র নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান তাঁরা।
তার আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় তাঁরা। বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বির আবাসিক হলের বরাদ্দকৃত সিট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে দিতে আল্টিমেটাম দেয় ছাত্র সংগঠনটি।
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ও শিক্ষা বিরোধী সিদ্ধান্ত বলে আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
এসময় নেতাকর্মীদের ‘মৌলবাদের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘শিবিরের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘জায়ামাত-শিবির-রাজাকার, তাড়াতাড়ি বাংলা ছাড়’, ‘শিবিরে আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে দেখা যায়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বাঙলা কলেজ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইউনিট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সমবেত হন।
অপরদিকে গত ক`দিন থেকেই ৫ দফা দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান নিয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সেখানে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা বলেন, রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের প্রবেশের মাধ্যমে বুয়েটে একটি কুচক্রী মহল ছাত্র রাজনীতি চালু করার অপচেষ্টা করছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদদ ছাড়া কোনো সংগঠন ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না। তাই দায়িত্ব অবহেলার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের পদত্যাগ এবং ইমতিয়াজ রাব্বির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বুয়েটের বাকি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন মেয়াদে হল এবং টার্ম বহিষ্কার করতে হবে। পাশাপাশি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা শিক্ষার্থীদের সামনে একে একে তুলে ধরা হয়। আয়োজন করা হয় গণস্বাক্ষর কর্মসূচির। এর আগে গত ২৭ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দপ্তর সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। আর ছাত্রলীগ নেতাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বি।
এরপরই ছাত্র রাজনীতি বন্ধসহ ৬ দফা দাবি পেশ করে শুক্রবার আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। এরপর শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলেন শিক্ষকরা। এ সময় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ রাব্বির হলের সিট বাতিল করার মৌখিক ঘোষণা দেন বুয়েটের উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার।
বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে দোষীকে শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দেন শিক্ষকরা। এরপর মধ্যরাতে বুয়েট প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের হলের সিট বাতিল করে।
এ ছাড়া সার্বিক বিষয়ে তদন্তপূর্বক সুপারিশ প্রদান করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান তাঁরা। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু বুয়েট শিক্ষার্থীরা শুধু হলের সিট বাতিলে সন্তুষ্ট নয় বলে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী শনিবার আবার আন্দোলনে নামে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তা চলবে বলে জানিয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা।
বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, আমি রাজনীতি করি, সেজন্য বুয়েটে আমি যেতে পারবো না? এটা কোন ধরনের আইন? এটা কোন ধরনের নিয়ম? গতকাল সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন তিনি।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সেদিন যা ঘটেছে, কেউ তো ওখানে রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি পালন করতে যায়নি! সেখানে তো কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না।তিনি আরও বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে একটা অপরাজনীতি-জঙ্গিবাদের কারখানায় রূপান্তরিত করা হবে, পরিণত করা হবে - এটা যাতে না হয়। আমরা তদন্ত করে দেখছি, এ ধরনের কিছু পাওয়া গেলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে।
শেখ হাসিনা অপকর্ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেন উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, সেই নীতিতেই আমরা এগিয়ে চলছি। আজকে বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার করতে গিয়ে আমাদের আমাদের অনেক কর্মী দণ্ডিত হয়েছে। তারপর বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডে আমরা কাউকে ছাড় দেইনি।
বুয়েটে জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে` আন্দোলনের নামে নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনও সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টু রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এ কথা জানান।
বুয়েটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পেছনে বিভিন্ন নিষিদ্ধ সংগঠন কলকাঠি নাড়ছে কিনা এবং ছাত্রশিবিরের বর্তমান সভাপতি বুয়েটের, এ বিষয়ে গোয়েন্দাদের কাছে কোনও তথ্য আছে কিনা জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। সেখানে আমাদের টিম রয়েছে। আমরা ঘটনাটি তদন্ত করছি, তদন্ত করে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এ আন্দোলন সংশ্লিষ্টতায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি বলেও জানান তিনি।
বুয়েটের বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে আমরাও সহমত, তবে এগুলো পূরণে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের জন্য সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
৩০ মার্চ দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা জানান। সত্য প্রসাদ মজুমদার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর সঙ্গে সহমত পোষণ করছি। কিন্তু সকাল ৯টা, দুপুর ২টা—এভাবে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। দাবি পূরণ করার জন্য যা যা করার, করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
তিনি বলেন, ‘নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারব না। নিয়মবহির্ভূতভাবে একজনকে বহিষ্কার করলে সেটা আদালতে টিকবে না। নিয়মের মধ্যে সবকিছু করার জন্য সময়ের প্রয়োজন। যেহেতু রোজার মাস, সময় একটু বেশি দেওয়া উচিত ছিল।
একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :