রাজধানী ও আশপাশের এলাকাসহ সারা দেশে গড়ে উঠেছে খাদ্য, ঔষধ, দেশী-বিদেশী নামী দামী ব্র্যান্ডের পণ্য, শিশু খাদ্যসহ নকল প্রসাধনী তৈরির প্রায় ১০ হাজার কারখানা। ঢাকা ও তার চারপাশ ঘিরেই রয়েছে প্রায় ৪ হাজার কারখানা। খানাঢুলি ও রেক নামের এসব কারখানা পরিচালিত হয় অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের মাধ্যমে। এসব কারখানায় উৎপাদিত নকল পণ্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।
জানা গেছে, আরেকটি চক্র সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কুয়েত, হংকং জাপান, মিয়ানমার, ভারত দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী দেশে এনে টেম্পারিং করে তারিখ পরিবর্তন করে বাজারে বিক্রি করছে। লাগেজ পার্টির মাধ্যমে সীমান্ত কিংবা বিমানবন্দর হয়ে এসব মালামালও পণ্য সামগ্রী দেশের বাজারে প্রবেশ করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়,
রাজধানীর কেরানীগঞ্জ, হাসনাবাদ, জুরাইন, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, শ্যামপুর, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা এলাকায় হাজার খানেক খুপরি কারখানাসহ ঢাকার চারপাশ ঘিরে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ,শীতলক্ষ্যা ও বালুনদীর তীর ঘেষে টঙ্গী, সাভার, নারায়ণগঞ্জ এসব এলাকায় বাড়ি ও ফ্লোর ভাড়া করে চলছে অবৈধ ব্যাবসা। নকল প্রসাধনী পণ্য ও মোড়ক উৎপাদন করে চকবাজার, সোয়ারীঘাট, নবাব কাটারাসহ পাইকারি মার্কেটগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। লাভ বেশী হয় বলে পাইকার ও অন্যান্য ব্যাবসায়ীদের কাছে এসব নকল পণ্যের চাহিদা বেশি। পুরান ঢাকার হাসনাবাদ গিয়ে দেখা যায়, একটি সাইনবোর্ড বিহীন বাড়িতে বাসক নামে একটি ঠান্ডা কাশির সিরাপ তৈরি করছে। লাইসেন্স বিহীন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন অর্ধ লক্ষ বোতল সিরাপ তৈরি হয়, যা সারাদেশে ঔষধের ফার্মেসী গুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
কামরাঙ্গীরচরের আলীনগর চৌরাস্তা দক্ষিণ পাশে গিয়ে দেখা যায়, মিন্টু মিয়ার হাসান পলিমার কারখানা। পণ্যের নকল বোতল, কৌটা ও নানান ধরনের প্যাকেট তৈরি করাই ওই কারখানাটির প্রধান ব্যবসা। কারখানাটিতে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির পণ্যের হুবুহু কৌটা ও মোড়ক তৈরি করা হয়। ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায়, কয়েকটি মেশিনে প্লাস্টিক দানা গলিয়ে বোতল, কৌটা ও কর্ক তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি একটি মেশিনে ডাইস ঠান্ডা করা হচ্ছে। চোরাই কারখানার কর্মরত একজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে,
প্রতি বস্তা প্লাস্টিক দানার দাম ৪ হাজার টাকা। প্রতিদিন কারখানা চালাতে অনেক খরচ হয়। সততার সাথে আসল পণ্যের ব্যবসা করলে বিলের টাকা তুলতে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। আর কপি মাল বানালে অগ্রিম টাকা পাওয়া যায়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এসব পণ্য বানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, শুধু আমরা নই, কামরাঙ্গীরচরে এমন দুই শতাধিক কারখানা রয়েছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক লিটার ওজনের প্রতি হাজার প্লাস্টিক কৌটা ৬ হাজার টাকায় বিক্রয় হলেও নকল পণ্যের কৌটা প্রতি হাজার ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এজন্য কারখানা মালিকরা পণ্য নকলকারীদের অর্ডার সাপ্লাই করতেই বেশি পছন্দ করেন।
সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০ হাজার নকল পণ্য সামগ্রী তৈরির কারখানার পাশাপাশি দুবাই, মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সহ অন্যান্য দেশ থেকে বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। টেম্পারিং কেমিক্যাল ব্যবহার করে পুরোনো লেখা উঠিয়ে নতুন মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া এসব পণ্য বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। পুরান ঢাকার কিছু জায়গায় গ্যাসের বোতল ডুপ্লিকেট করে এর সাথে পানি মেশানো হয়।এভাবে গ্যাসের একটি বোতল ভেঙে দুই বোতল বানানো হয়।
যেসব পণ্য নকল করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে,
চাউল, মুরগির ডিম, দেশি-বিদেশি কোম্পানির ঔষধ, শিশু খাদ্য, জুস, জর্দা, গরু, মুরগী ও গরুর খাদ্য, বিভিন্ন মুখরোচক বেকারি পণ্য, খাবার তৈরি হয়। প্রসাধনী সামগ্রীর মাঝে, বিশ্বমানের ব্র্যান্ড গার্নিয়ার, লরেল, রেভলন, হেড অ্যান্ড শোল্ডার, লাক্স লোশন, অ্যাকুয়া মেরিন লোশন, পেনটিন, নিভিয়া, ফেড আউট ক্রিম, ডাভ সাবান, ইমপেরিয়াল সাবান, সুগন্ধির মধ্যে হুগো, ফেরারি, রয়েল, হ্যাভক ও কোবরা। অলিভ অয়েল কিওকারপিন, আমলা, আফটার সেভ লোশন, জনসন, ভ্যাসেলিন হেয়ার টনিক, জিলেট ফোম, প্যানটিক প্রোভি ও হারবাল অ্যাসেনশিয়াল লোশন। এছাড়া ইউনিলিভারের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, ফগ বডি স্প্রে ও ইতালিয়ান ব্র্যান্ডের নামিদামি নেইল পলিশ, সেভিং ফোম, সেভিং লোশন ও ক্রিম, পারফিউম, তেলকম পাউডার, সুগন্ধি কেশ তেল, বিউটি ক্রিম, স্যাম্পু, কন্ডিশনার প্যারাসুট, কুমারিকা, ডাবর আমলা, কিউটসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নারিকেল তেল।
এসব কারখানায় অনেক সময় অভিযান পরিচালনা করে মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই ও বিভিন্ন আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর টিম। কিন্তু তাতে করে কাজের কাজ কিছুই হয়না। অবৈধ আয়ের টাকায় জরিমানা গুনতে সমস্যা হয়না তাদের। এরা ছয়মাস এক বছর পরপরই জায়গা বদল করে। একজায়গায় সিল গালা করা হলে পরের দিন অন্য জায়গায় গিয়ে ব্যাবসা শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়,
গ্যাস, বিদ্যুৎ এর অবৈধ সংযোগের জন্য সংশ্লিষ্টদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ রাখতে হয়। পাশাপাশি এলাকার বড়ভাই, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যাক্তি, মাস্তান সন্ত্রাসী,অসাধু সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশকে ম্যানেজ করেই তারা এসব অবৈধ কারখানা পরিচালনা করে থাকে। যে কারণে তাদের কারখানা বন্ধ করা যায় না।
এসব অবৈধ সামগ্রী বিক্রির বড় পাইকারি বাজার হলো- লালবাগ, চকবাজার, মৌলভীবাজারের মোতালেব মার্কেট, মরিয়ম প্লাজা, ১০ নম্বর গলি, পুরান খান মার্কেট, মুনসুর খান মার্কেট, রহমান মার্কেটসহ রাজধানীর পুরান ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকার নামীদামি মার্কেট ও শপিংমল।
এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন,
নকল প্রসাধনীর দৌরাত্ম্যে আমাদের বৈধ ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। নকল পণ্য উৎপাদনকারীরা অনেক শক্তিশালী। সবাইকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখেছে। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত এসে কিছু শাস্তি দিয়ে চলে যায়। পরে অর্থদণ্ড দিয়ে একই কাজ শুরু করে নকল পণ্যের ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে সচেতন মহল মনে করেন, ভেজাল প্রতিরোধে প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে আইনি ব্যবস্থা জোরদারসহ গণমাধ্যমকে আরও সোচ্চার ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন । সর্বোপরি ভোক্তাদের নকল পণ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
একজন ভুক্তভোগী ক্রেতা বলেন, নকলবাজরা দেশ ও জাতির শত্রু।আমি ব্যাক্তিগত ভাবে কিছু পণ্য কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এদের কারণে প্রকৃত ব্যাবসায়ী নিরীহ ক্রেতাসাধারণ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে দাবি জানান সে।
একুশে সংবাদ/হ.ক.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :