AB Bank
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad
ekusheysangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

জমজমাট অনলাইন জুয়া, পথ হারাচ্ছে তরুণ সমাজ


Ekushey Sangbad
জাহাঙ্গীর আলম
০২:৪৯ পিএম, ২৭ জুন, ২০২৪
জমজমাট অনলাইন জুয়া, পথ হারাচ্ছে তরুণ সমাজ

  • অনলাইনে জুয়ার টাকা লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশীয় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস
  • অপরাধী চক্র দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার করছে
  • ফাঁদে ফালতে দেওয়া হয় আকর্ষণীয় অফার
  • জুয়ায় আসক্ত হয়ে ভাঙ্গছে সংসার

অনলাইনে জমজমাট আসর বসছে জুয়ার। আর এটি পরিচালনা হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাইট থেকে। লোভনীয় বিজ্ঞাপনে এসব জুয়ার সাইটের ফাঁদে পা দিচ্ছেন নানা বয়স ও পেশার মানুষরা, যার অধিকাংশই তরুণ। ফলে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। জুয়াড়িচক্রের সদস্যরা মাঝে-মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও বেশিরভাগই থাকছে অধরা।

এতদিন বিদেশি আয়োজনে এসব জুয়ার সাইট চললেও এখন দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষও বিশেষ করে তরুণ-তরুণীরা এসব জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। খোয়াচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা। অনেকে ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। পকেটমানির সঙ্গে কিছু বাড়তি টাকা যোগ করার আশায় অনলাইন জুয়ার কালো ছায়ায় জড়িয়ে পড়ছেন তারা। জুয়ার আদতে চলছে প্রতারণা। জুয়ায় বড় অংকের টাকা লাগাতে আগ্রহী করতে প্রথম দিকে কিছু টাকা জিতিয়ে তৈরি করা হয় লোভের ফাঁদ।

টিভিতে খেলা চালাকালীন এখন নিয়মিত দেখা যায় বিভিন্ন বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন। প্রতিটি ওভার শেষে নিয়মিতভাবে আসছে এই বিজ্ঞাপন। যে বিজ্ঞাপনে আপনাকে মুঠোফোনের অ্যাপে জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। শুধু তাই না, বিজ্ঞাপনে যারা নেচে নেচে জুয়া খেলার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তারাও কিন্তু যথেষ্ট পরিচিতমুখ।

তাছাড়া, বিভিন্ন স্বনামধন্য গণমাধ্যমের সংবাদ উপস্থাপকের ভিডিওর সাথে বানোয়াট কন্ঠজুড়ে দিয়েই বানানো হচ্ছে জুয়ার বিজ্ঞাপন। 

যেহেতু বাংলাদেশে ৫ কোটি ৫৬ লাখের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী আছে এবং তাদের বেশিরভাগের কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে এসব বিজ্ঞাপন। শুধু ফেসবুক নয়, ইউটিউব-ইনস্টাগ্রাম প্রায় সব সোশ্যাল মিডিয়াতেও সেটা ছড়াচ্ছে।

অন্য একটি বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছে সাকিব আল হাসানের একটি এআই ভার্সন তৈরি করে। এক সাকিবের ছবি-ভিডিও আর এআই দিয়ে কৌশলে শতাধিক জুয়ার বিজ্ঞাপন এখন ঘুরছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। যেহেতু নানা সময় সাকিব আল হাসানের সাথে জুয়াড়িদের নাম জড়িয়ে ছিলো, তাই মানুষ এসব কারসাজিকে সত্যি মনে করছে এবং ধরেই নিচ্ছে এটি সত্যি।

আবার আরেকটি বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় মুশফিকুর রহিম সবাইকে সাকিব আল হাসানের জুয়ার অ্যাপে যুক্ত হতে বলছেন। মুশফিকের ভয়েজটা যেহেতু আমাদের সবার পরিচিত, তাই বিজ্ঞাপনে দেয়া ভয়েজটাও পরিচিত লাগছে। এবার যদি একটু খেয়াল করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে, মুশফিকুর রহিমকে দেখা যাচ্ছে তার চোখের পলক পড়ছে না। ভ্রু নড়ছে না এবং তিনি বক্তব্যের মধ্যে কোনো দম নিচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী একুশে সংবাদকে বলেন,

‘আমাদের ক্যাম্পাসে অনলাইন জুয়ার প্রভাব বেড়েই চলছে। আর আমি শুরু করি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে। বলল একটা বেটিং অ্যাপ আছে সেখানে টাকা ইনভেস্ট করলে অনেক টাকা-পয়সা আসে।’ ওই শিক্ষার্থী প্রথমে বিশ্বাস না করলেও তার ওই বন্ধুকে জুয়ায় টাকা আয় করতে দেখে সেও আগ্রহী হয়ে টাকা লাগান। শুরুর দিকে টাকা আসলেও দিন দিন আমার টাকা যেতে শুরু করে। প্রথম দিকে ভাবতাম দেই সমস্যা নেই, আসবেই তো। কিন্তু একটা সময় দেখা যায় এভাবে আমার প্রায় ৫০ হাজার টাকা চলে গেছে।  

পুরান ঢাকার রাশেদুল হাসান (ছদ্মনাম) নামের এক তরুণ একুশে সংবাদকে বলেন, ‘আমি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক। সারাদিন দোকানেই বসে থাকি। হাতে মোবাইল থাকেই। গেম খেলে সময় কাটাই। একসময় বন্ধুদের মাধ্যমে অনলাইনে বেট ধরা শুরু করি। এটা করতে গিয়ে আজ আমি ফতুর হয়ে গেছি বলা যায়।’

বাংলাদেশে অনলাইন জুয়াড়ির সংখ্যা কত? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 

‘লাখ লাখ মানুষ খেলে। বিভিন্ন বেটিং সাইটে বিভিন্ন রকম নিয়ম রয়েছে। কোথাও কম টাকায় খেলা যায়, কোথাও সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা বা ১০০০ টাকা জমা রাখতে হয়।’

একুশে সংবাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, 

ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোভনীয় অফারের নানা ভিডিও এবং বুস্ট করা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অধিকাংশ জুয়া বা বেটিং সাইটগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এসব সাইটে বুঝে না বুঝে একটি মাত্র ক্লিকে অ্যাপস কিংবা ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শুরুতে সদস্য টানতে অবলম্বন করা হচ্ছে কৌশল। অল্প টাকায় লাখপতি হওয়া বা দ্বিগুণ মুনাফার লোভে অন্ধকার এ জগতে পা বাড়াচ্ছে মানুষ। একসময় লোভে পড়ে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করেন তারা। তখনই বেরিয়ে আসে আসল রূপ। মোটা অঙ্কের টাকা মুহূর্তেই হারিয়ে যায় জুয়ার বোর্ডে।

আর অনলাইনে জুয়ার টাকা লেনদেনে ব্যবহৃত হচ্ছে বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো দেশীয় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসগুলো (এমএফএস)। এছাড়া ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ থাকায় দৌরাত্ম্য বাড়ছে বিদেশি প্রতারকচক্রগুলোর।  

জানা যায়, 

অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম বা ওয়েবসাইটের ডোমেইন ও হোস্টিংয়ের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় দেশের বাইরে থেকে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের কিছু চক্র আছে যারা বাইরে বসে এই সাইট পরিচালনা করে। তাই তাদের সহজে ধরা যায় না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব জুয়ার সাইট বাংলাদেশেও পরিচালনা করছে তাদের এজেন্টরা। জুয়ায় বিনিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। জুয়ায় টাকা ঢুকালে সাব-এজেন্টরা কমিশন পায়। আবার টাকা কেউ উঠালেও কমিশন দিতে হয়। একজন সাব-এজেন্টের আন্ডারে যদি প্রতিদিন ২০ লাখ টাকা জুয়ায় লেনদেন হয়, তা হলে কমিশন হিসেবে তিনি ১০-১৫ হাজার টাকা পান। সাব-এজেন্টের কয়েকগুণ বেশি কমিশন পান মাস্টার এজেন্ট। সাব-এজেন্ট সাধারণ জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। টাকা গ্রহণ ও উত্তোলন মূলত সাব-এজেন্টদের মাধ্যমেই হয়।

 

ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, 

অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের সূচক ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়ার বাজারমূল্য ছিল ৬ হাজার ৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েক হাজারের বেশি জুয়ার সাইট বন্ধ করেছে সরকার কিন্তু জুয়ার সাইট এ দেশে বন্ধ করলেও জুয়াড়িরা ভিপিএন বা অন্য উপায়ে ঠিকই সাইট ব্যবহার করছে।

প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, 

ডিজিটাল দুনিয়ার অপরাধগুলো দমন করতে হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। ধড়পাকড় করে আসলে এগুলো থামানো যাবে না। এগুলো বন্ধের জন্য জোরদার করা দরকার ভার্চুয়াল নজরদারি। একই সঙ্গে এই অনলাইন জুয়ায় যে মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, সেই তথ্যগুলো তুলে ধরে সচেতনতা বাড়ানো। তবে দিনশেষে যারা বড় পরিসরে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন তৈরি করছেন বা তাতে মডেল হচ্ছেন, তাদেরকে নৈতিকভাবে সেখান থেকে সরে আসার আহবানও জানান তারা।

কারা কিভাবে এটা ছড়াচ্ছে? এর উত্তর খুঁজতে কথা হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম- সিটিটিসি’র প্রধান মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের সাথে। 

তিনি বলেন, কোন কোন দেশ থেকে এটি পরিচালিত হয় সেটি খুঁজতে খুঁজতে সব শেষে গিয়ে দুবাইয়ের নাম আসে। এসব জুয়ার প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশে। এজেন্টদের মাধ্যমে জুয়ার কার্যক্রম চলছে। পুলিশ তাদের নিয়মিত অভিযানে তাদের আটক করলেও মূল চ্যালেঞ্জটা হয় দেশের বাইরে থাকাদের আটকের ক্ষেত্রে। কারণ, বাংলাদেশের দিক থেকে এই অপরাধীদের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে চিঠি দেয়া হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার কোনো উত্তর মেলে না। ফলাফল, এরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্বভাবতই বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থও দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, 

আমি এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশের ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়েরা যুক্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি অনেক বয়স্ক, রিটায়ার্ড ব্যক্তিরাও এর মধ্যে আসছেন। গেলো সোমবার সচিবালয়ে তিনি জানান, মোট দুই হাজার ৬০০টি জুয়ার সাইট ব্লক করা হয়েছে, সমান্তরালে বন্ধ করা হচ্ছে জুয়ার অ্যাপগুলো। এই অভিযান চলমান থাকবে।

জুয়ার মাধ্যমে যে শুধু দেশের কিংবা ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থার ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপারটা তা নয়। জুয়ার কারণে সংসারে অশান্তি, সন্তান বা সঙ্গীর বিপথগামিতা, বিবাহবিচ্ছেদ, ত্যাজ্য সন্তানে পরিণত হওয়া, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার মতো সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত আজ অসংখ্য পরিবার। অন্যদিকে দেউলিয়া হয়ে পথে বসা, ব্যবসার ভরাডুবি, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া, সম্পত্তি বিক্রি, অলংকার আসবাব বিক্রি করার মতো অর্থনৈতিক সংকটও ঘটছে জুয়ায় আসক্তির কারণে। চূড়ান্ত পরিণতিতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা কিংবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

জুয়া খেলায় আসক্ত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমে তার সমস্যাটা ভালো করে বুঝতে হবে এবং এই নেশা থেকে বের হতে তাকে উৎসাহ দিতে হবে। ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং অতীতের কথা আলোচনা করা যাবে না। শুধু বর্তমানের সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে এবং জুয়া কীভাবে একজন মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে সেই বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা জরুরি। এক্ষেত্রে জুয়ার নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বুঝিয়ে বলতে হবে। একজন জুয়াড়িকে সতর্ক করতে হবে।

 

একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা

Link copied!