বাড়ির পাশে বাঁশঝাড় আর বেত বনের ঐতিহ্য গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ। যেখানে গ্রাম, সেখানে বাঁশঝাড়-এমনটিই ছিল স্বাভাবিক। এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। কিন্তু এখন যেভাবে গ্রামীণ বৃক্ষরাজি উজাড় হচ্ছে তাতে হারিয়ে যাচ্ছে এ জাতীয় অজস্র গাছপালা। বাংলাদেশের জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ ও বেতশিল্প। অপ্রতুলতা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে বিলুপ্ত হতে চলেছে এই শিল্প। বর্তমান বাজারে প্লাস্টিক পণ্য সামগ্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়েছে এটির। অপরদিকে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় অভাব-অনটনের মধ্যে দিনযাপন করছেন বাঁশ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে তারা এ পেশাকে ছেড়ে অন্য পেশায় ঢুকে পড়ছেন।
একসময় গ্রামীণ জনপদে বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হতো হাজারো পণ্যসামগ্রী। ঘরের কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ কেটে গৃহিণীরা তৈরি করতেন হরেকরকম জিনিস। অনেকে এ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। দরিদ্র পরিবারের অনেকের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল এগুলো। কিন্তু আজ বাংলাদেশের কটি গ্রামে হস্তশিল্পটি উপার্জনের পেশা হিসেবে বেঁচে আছে, তা ভাবনার বিষয়। এ শিল্পে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার আমলের পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন।
কয়েক বছর আগেও এ দেশের তৈরি বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসের কদর ছিল। চেয়ার, টেবিল, বইয়ের সেলফ, মোড়া, কুলা, ঝুড়ি, ডোল, চাটাই থেকে শুরু করে এমনকি ড্রইংরুমের আসবাবপত্র তৈরিতেও বাঁশ ও বেত প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া মাছ ধরার পলো, হাঁস, মুরগির খাঁচা, শিশুদের ঘুম পাড়ানোর দোলনা এখনো গ্রামাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। একসময় এ দেশের গ্রামাঞ্চলে বিপুল পরিমাণে এসব বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়ে যেত। এখন সচরাচর গ্রামীণ উৎসব বা মেলাতেও বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি উন্নত মানের খোল, চাটাই, খালুই, ধামা, দোয়াড়, আড়ি, টোনা, আড়, হাপটা, পাল্লা, মোড়া, বুকসেলফ চোখে পড়ে খুব কম। যেখানে তালপাতার হাতপাখারই কদর নেই, সেখানে অন্যগুলো তো পরের কথা।
বাঁশ-বেত শিল্পীরা জানান, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি কুলা, চালুন, মোড়া, বই রাখার তাক, চেয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের বাঁশ ও বেত সামগ্রী কালের বিবর্তনে হারানোর পথে। এ শিল্প রক্ষায় কাউকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি ধরে রাখতে শিল্পীরা অনেক ত্যাগ, কষ্ট, দুঃখ সহ্য করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে বাঁশ ও বেতের ঝাড় উজাড় করার ফলে কত দিন এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি টিকে থাকবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, যে বাঁশ আগে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় পাওয়া যেত, সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। বাঁশের দাম যেমন বেড়েছে সেই পরিমাণ বাড়েনি এসব পণ্যের দাম। চাহিদা অনুযায়ী বাঁশের উৎপাদন কম থাকার কারণে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ঘর বাড়ি নির্মাণে প্রয়োজন মতো বাঁশ বৃদ্ধি হচ্ছে না।
ময়মনসিংহ জেলার তারাকান্দা উপজেলার বাজারে বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রি করতে আসা আলী হোসেন (৫৫) জানায়, তাদের গ্রামে বেশকয়েকটি পরিবার এ কাজে নিয়োজিত আছে। অতি কষ্টে বাঁশ শিল্প টিকিয়ে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে কোনোরকম জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তারা।
বয়োজ্যেষ্ঠরা বলছেন, গ্রামীণ জনপদে বাঁশ ছিল একটি ঐতিহ্য। প্রতি বাড়িতে কমবেশি চাষ হতো বাঁশ। যা দিয়ে তৈরি হতো নিত্যদিনের গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত সকল ধরনের জিনিসপত্র। তবে এখনো মাঝেমধ্যে গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশ ও বেতজাত শিল্পীদের তৈরি খোল, চাটাই, খলুই, ধামা, টোনা, পাল্লা, মোড়া, বাইর, পাতি, খাচা, উন্যা চোখে পড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাঁশের দাম বৃদ্ধি, খরচের তুলনায় লাভ কম ও দিনদিন চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র এ শিল্পের কারিগরদের অধিকাংশই এখন আদি পেশা বদল করে কৃষিসহ নানা পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে বাঁশ-বেতের স্থান অনেকটাই প্লাস্টিক সামগ্রী দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে বাঁশ ও বেতের সামগ্রী থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী কেনার প্রতি আগ্রহ বেশি। তাছাড়া এখন বাঁশ ও বেতের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়ে গেছে। ফলে বাঁশ ও বেতের সামগ্রীর ব্যয়ও বেশি হচ্ছে। শৌখিন মানুষ ঘরে বাঙালির ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য বাঁশ বেতের সামগ্রী বেশি দাম দিয়ে কিনলেও মূলত ব্যবহারকারীরা বেশি দাম দিতে চান না। স্বল্প আয়ের মানুষেরা সমিতি কিংবা সমিতি থেকে সুদের বিনিময়ে টাকা নিয়ে বাঁশ ও বেতজাত দ্রব্যসামগ্রী তৈরি করে বিক্রি করলেও এতে তাদের খরচ পোষায় না। এর ফলে তারা অন্য পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে।
একুশে সংবাদ/ন.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :