জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় অলিম্পিকের মশাল। সিন নদীর তীরে ভালোবাসা আর প্রেমের শহর প্যারিসে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ খ্যাত অলিম্পিকের আসর মুগ্ধতা ছড়ানোর অপেক্ষায়। শিল্প-সাহিত্য আর ঐতিহ্যে ফ্রান্স আর প্যারিসের মতো মুগ্ধতা ছড়াতে পেরেছে বিশ্বের খুব কম শহর। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলস আর যুক্তরাজ্যের লন্ডনের পর তৃতীয় শহর হিসেবে তিনবার অলিম্পিক আয়োজন করছে প্যারিস। ২৬ জুলাই এ মেগা আয়োজনের উদ্বোধন করা হবে।
১৯০৪ আর ১৯২৪ সালে প্যারিস ছিল অলিম্পিকের শহর। এরপর ঠিক ঠিক ১০০ বছর পর ২০২৪ সালে এসে আরও একবার অলিম্পিক ফিরলো ঐতিহাসিক এই শহরে। তবে ফ্রান্সে অলিম্পিকের প্রত্যাবর্তন আপাতত বিতর্কিত আর কিছুটা সংশয়ের। অলিম্পিক আনুষ্ঠিকভাবে শুরুর আগেই মাঠে গড়িয়েছে ফুটবল ইভেন্ট। তাতে উদ্বোধনী ম্যাচেই ছিল বিতর্ক।
ইসরায়েলের জন্য পুরো আসরেই বাড়তি নিরাপত্তার বিধান রেখেছে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ সামরিক শক্তি ফ্রান্স। আর এই নিয়ে ক্ষোভ জমেছে ব্যাপক আকারে। সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ব্যাপক প্রাণহানির পরেও তাদের বাড়তি নিরাপত্তা এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে অলিম্পিকে আমন্ত্রণের বিরোধিতা করেছেন অনেকেই।
গাজায় যুদ্ধের প্রতিবাদে ইসরায়েলকে প্যারিস অলিম্পিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল ফিলিস্তিন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) প্রধান টমাস বাখ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ গতকাল ফিলিস্তিনের এই দাবি নাকচ করে দেন। বাখ নিজেকে ‘রাজনৈতিক ব্যবসা’য় জড়াবেন না জানিয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন বলেছেন, ‘আমাদের দেশে ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের স্বাগতম। তাদের অবশ্যই নিজ পতাকার অধীনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে, কারণ অলিম্পিক মুভমেন্ট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
ফ্রান্সের এমন নীতি অবশ্য রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না। রুশ অ্যাথলেট নিষিদ্ধ হয়েছেন, সেইসঙ্গে রাশিয়ান কোনো গণমাধ্যমকর্মীকেও এবারের অলিম্পিকে প্রবেশ করতে দেয়নি ফ্রান্স এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। আয়োজক দেশের বিশ্বাস, সাংবাদিকতার নামে তাদের দেশে গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারে রুশ সাংবাদিকরা।
ফ্রান্সের বামপন্থী আইনপ্রণেতা থমাস পর্টেস সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গত শনিবার এক প্রো-ফিলিস্তিন র্যালিতে অংশ নিয়ে জানিয়েছেন, ইসরায়েলের কূটনীতিকরা ফ্রান্সের মাটিতে আমন্ত্রিত না। তিনি ফ্রান্সের সরকারকে নিজেদের ‘দ্বিমুখী নীতি’ থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানান। একইসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘রাশিয়ার মতো’ ইসরায়েলের পতাকা এবং জাতীয় সংগীতও অলিম্পিকে নিষিদ্ধ করা দরকার।
ইসরায়েলের হয়ে অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়া ৮৮ অ্যাথলেটের মধ্যে অন্তত ১৫ জন হামলা ও মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। সবমিলিয়ে শুধুমাত্র ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের ওপর ১ হাজার ৭০০ এর বেশি হুমকি আছে বলে জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য হুমকিও মাথায় নিতে হচ্ছে আয়োজকদের।
এতকিছুর পরেও অবশ্য ফিলিস্তিনের পক্ষে মন্তব্য ঠেকিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে ফ্রান্সের জন্য। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলকে নিয়ে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে ফ্রান্সের সক্রিয় গোষ্ঠী ইউরোপ্যালেস্টাইন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গাজায় ‘গণহত্যা’র প্রতিবাদে স্টেডিয়ামের ভেতরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ইউরোপের সবচেয়ে বড় মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ফ্রান্স। তবে দেশটি পরিচালিত হয় ধর্মনিরেপেক্ষতার ভিত্তিতে। এমন অবস্থায় দেশটির কোনো নারী ক্রীড়াবিদ হিজাব পরিধান করে অলিম্পিকে খেলতে পারবেন না বলে আগেই আইন পাশ করেছিল ফ্রান্স সরকার। আর বিষয়টাকে মোটেই সহজভাবে নেয়নি বিশ্বের একটি বড় অংশ।
হিজাব নিয়ে এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে ফ্রান্সেরই দৌড়বিদ সুনকামবা সাইলার অলিম্পিকে অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফ্রেঞ্চ এই অ্যাথলেট রিলে দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মুসলিম এই নারী অ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাকে নামেন হিজাব নিয়েই। বাকিদের সঙ্গে তার স্যুটেও আছে পার্থক্য।
নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন ফ্রেঞ্চ স্প্রিন্টার সুনকামবা সাইলা, ‘আপনি অলিম্পিক গেমসের জন্য নির্বাচিত হয়েছে, যা কিনা আপনারই দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনি অংশ নিতে পারছেন না। কারণ মাথার ওপর আপনি একটা স্কার্ফ (হিজাব) পরিধান করেন।’
অবশ্য গেমসে অন্য দেশের ক্রীড়াবিদরা হিজাব পরিধান করতে পারবেন। তবে ফ্রান্সের সেক্যুলার আইন দেশটির সব মুসলিম নারী ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরইসঙ্গে ফ্রান্সে অবস্থানকারী অভিবাসীদের ক্যাম্পে কোনো ক্রীড়াবিদ ভ্রমণ করতে পারবেন না বলেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। দুটো সিদ্ধান্তই মুসলিম ক্রীড়াবিদদের বিপক্ষে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেকেই।
ফ্রান্সের বামপন্থী আইনপ্রণেতা থমাস পর্টেস সরকারের এমন সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। গত শনিবার এক প্রো-ফিলিস্তিন র্যালিতে অংশ নিয়ে জানিয়েছেন, ইসরায়েলের কূটনীতিকরা ফ্রান্সের মাটিতে আমন্ত্রিত না। তিনি ফ্রান্সের সরকারকে নিজেদের ‘দ্বিমুখী নীতি’ থেকে বেরিয়ে আসার দাবি জানান।
আছে নিরাপত্তার শঙ্কা
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলের অ্যাথলেটদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। ফিলিস্তিনপন্থী ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপ সেবারে ৯ ইসরায়েলি অ্যাথলেটকে জিম্মি করে। পরবর্তীতে পশ্চিম জার্মান সরকারের পুলিশি অভিযান চালানো হলে ৯ বন্দী অ্যাথলেট, ৫ আক্রমণকারী এবং ১ পুলিশ সদস্য নিহত হন।
এরপর থেকেই অলিম্পিকে ইসরায়েল নিজেদের অ্যাথলেটদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। যার সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছে ফ্রান্স পুলিশের নিরাপত্তা। কিন্তু এরপরেও স্বস্তিতে নেই ফ্রান্সের পুলিশ বিভাগ।
জানা যায়, ইসরায়েলের হয়ে অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়া ৮৮ অ্যাথলেটের মধ্যে অন্তত ১৫ জন হামলা ও মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। সবমিলিয়ে শুধুমাত্র ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের ওপর ১ হাজার ৭০০ এর বেশি হুমকি আছে বলে জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য হুমকিও মাথায় নিতে হচ্ছে আয়োজকদের।
একুশে সংবাদ/ এসএডি
আপনার মতামত লিখুন :