করোনা মহামারির পর আবার বড় ধাক্কা খেয়েছে কক্সবাজারের পর্যটন খাত। এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশের অন্যতম এ পর্যটন অঞ্চলের প্রতিটি খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থমকে যায় সমুদ্রশহরের প্রত্যেকটি পর্যটন স্পট।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এতে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ৫ কোটি টাকারও বেশি। তাদের দাবি, এমনটা চলতে থাকলে কক্সবাজারের পর্যটনখাত অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে।
কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রগুলো সমুদ্রকেন্দ্রিক। সারাবছর এখানে কমবেশি পর্যটক থাকে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কক্সবাজারের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় থাকে উপচে পড়া। তবে চলতি মৌসুমের শুরুতেই প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে এখানকার পর্যটনখাত বড় ধাক্কার মুখে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষত শুকিয়ে সব গুছিয়ে ওঠার আগেই ফের বড় ধাক্কার মুখে পড়তে হয়। দেশের সহিংস পরিস্থিতি আর কারফিউয়ের কারণে বিরাট বিপর্যয়ে পড়ে কক্সবাজারের পর্যটন। গত ১৬ জুলাই থেকে পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল ও রিসোর্টে তেমন পর্যটক নেই। বুকিংও পড়েনি। পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে নেমে আসে সুনসান নীরবতা। কক্সবাজারের ইনানী, হিমছড়িসহ অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রগুলো ফাঁকা বললেই চলে।
এক হিসেবে দেখা যায়, কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক হোটেল মোটেল ও রিসোর্টে ধারণ ক্ষমতা ২ লাখেরও বেশি। ছুটির দিনগুলোতে লাখো পর্যটনের সমাগম ঘটে থাকে এখানে।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, নিস্তব্ধতা চারদিকে। হোটেল-মোটেল খালি পড়ে আছে। পাঁচ শতাধিক রেস্তোঁরা ও চার হাজারের বেশি দোকানে বেচাবিক্রি নেই । সৈকতের ঐতিহ্যবাহী ঝিনুক মার্কেট, ছাতা মার্কেটসহ আশেপাশের বেশির ভাগ ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। সমুদ্রসৈকতে সারি সারি বিচ বাইক, ওয়াটার বাইক (জেটস্কি) থাকলেও বেশিরভাগই চালক নেই। সড়কের মোড়ে মোড়ে ছাদ খোলা ট্যুরিস্ট জিপ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক ও রিকশাচালকরা গল্প, আড্ডায় সময় পার করছেন।
এমন পরিস্থিতিতে লোকসানে পড়েছেন ট্র্রাভেল এজেন্সি, হোটেল-মোটেল রেস্তোঁরাসহ সংশ্লিষ্ট শতাধিক খাতের উদ্যোক্তরা।
কলাতলী চন্দ্রিমা ঘোনা এলাকার শাহাব উদ্দিন আগে রিকশা চালিয়ে দৈনিক ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা আয় করতেন। কিন্তু তিনি গেল এক সপ্তাহে দৈনিক ৪০০ টাকাও আয় করতে পারেননি। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই চালক বলেন, ‘দৈনিক সংসারে খাবারের খরচই টেনেটুনে ৫০০ টাকা লাগে। অন্যান্য খরচের কথা বাদই দিলাম। কক্সবাজারে পর্যটক এলেই আমাদের পেট চলে। পযর্টক না এলে উপোস থাকতে হয়। বেশ কয়েকদিন ধরে শহরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। পর্যটক নেই, আমাদের আয়ের উৎসও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
ছাদ খোলা ট্যুরিস্ট জিপের চালক খোকন বলেন, ‘কক্সবাজারে পর্যটক আসার উপর নির্ভর করে আমাদের জীবন জীবিকা। পর্যটক নেই তো আমাদের আয় বন্ধ। অথচ পর্যটক থাকলে আমরা শহর থেকে ইনানী গেলেই ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা পাই। গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কক্সবাজারে পর্যটক নেই। ফলে আমাদের বেকার সময় কষ্টে যাচ্ছে।’
সৈকতের লাবণী পয়েন্টে দুই যুগের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করে আসছেন মোহাম্মদ আমান। আমান ভাইয়ের চটপটি হিসেবে তার দোকানের সুপরিচিতি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘পর্যটন মৌসুম না হলেও বর্তমান অবস্থার মতো দুঃসময় আমাদের আর যায়নি। আগে আমাদের দৈনিক ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বেচাবিক্রি হতো। এখন ২ হাজার টাকা বিক্রি করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দৈনিক দোকানের খরচ ৩ হাজার টাকা। বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার টাকা। প্রতিদিন ১ হাজার টাকা ক্ষতি হয়। লাভের মুখ দেখছি না অনেকদিন।’
কক্সবাজারের অন্যতম সুপরিচিত পযর্টন স্পট ইনানীর পযর্টন ব্যবসায়ী ও ইনানী বিচ ক্যাফের স্বত্ত্বাধিকারী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হিমছড়ি, ইনানী ও পাটোয়ারটেকে ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু এখন মোটেও পযর্টক নেই। কাজের লোকজনসহ ২ শতাংশ পর্যটক আছে। এদিকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর খুবই নাজুক অবস্থা। আমাদের ‘ইনানী বিচ ক্যাফেতে’ কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎবিল, দোকান ভাড়াসহ দৈনিক ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ আছে। এভাবে লোকসানে যাচ্ছে সময়।’
এই ব্যবসায়ীর মতো আয় ছাড়া দৈনিক ২০ হাজার টাকা খরচের কথা জানিয়েছেন হোটেল কক্সবাজার ও সাউথ বিচের পরিচালক মোস্তাক আহমদ। হোটেলের কর্মচারীসহ প্রতিদিন আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে গিয়ে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানান।
কলাতলী সৈকত থেকে লাবণী সৈকত পর্যন্ত চানাচুর, চিপস্ ও পানি বিক্রি করেন সমিতিপাড়ার কফিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘সৈকতে সরাসরি নেমে এসব বিক্রি করতে নিষেধ আছে। তারপরও পেটের দায়ে পুলিশ, বিচকর্মী আসছে কিনা দেখে বিক্রি করি। পর্যটক থাকলে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মতো পেতাম। কিন্তু এখন একদম বেচাবিক্রি বন্ধ। টানাপোড়নের সংসারে অভাব চলছে।’
আচার ব্যবসায়ী বাবুল হোসেন বলেন, ‘এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে যা আয় হয় তাতে ৮ সদস্যের সংসার চলে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচও এখান থেকে চলে। কিন্তু বেশকিছুদিন ধরে পর্যটক না থাকায় বেচাবিক্রি নেই। সারাদিন দোকান খুলে বসে আছি, কিন্তু এক টাকাও বিক্রি করতে পারিনি।’
কক্সবাজার হোটেল—মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, ‘১৬ জুলাই থেকে কক্সবাজারে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পযর্টনখাতে প্রভাব পড়েছে। এরই মধ্যে কারফিউ চলার কারণে দূর দূরান্তের পর্যটক কক্সবাজারে আসতে পারছেন না। যারা আকাশপথে আসছেন তারা কোন না কোন কাজে আসছেন বা সংখ্যামাত্র কিছু লোক এসে ভ্রমণ করে যাচ্ছেন। তারা কিন্তু থ্রি-ফোর স্টার মানের হোটেলে থাকছেন। এতে মধ্যমানের হোটেল ব্যবসায়ীরা খুবই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ভরা মৌসুম না হলেও কক্সবাজারে নিয়মিত ৩০ হাজার মতো পর্যটক থাকে। কিন্তু এখন তাও নেই। ফলে প্রতিটি পর্যটন খাতে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমরা চাই এই কঠিন পরিস্থিতি দ্রুত কাটিয়ে উঠুক। আবার পযর্টন খাতে সুদিন ফিরে আসুক।’
ওই সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘পর্যটনশহর কক্সবাজারে আশানুরূপ পর্যটক থাকলে প্রতিটি খাতে ভালো ব্যবসা বাণিজ্য হয়। এ জেলার মানুষ পযর্টনের উপর নির্ভরশীল বললেই চলে। কিন্তু এখন পযর্টক নেই। সবকিছুতে লোকসান আর লোকসান। পর্যটক না থাকায় শুধু হোটেল ও রেস্তোঁরায় প্রতিদিন গড়ে ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। করোনার পর এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কক্সবাজারের পর্যটনের জন্য অনেক বড় ধাক্কা।’
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘কোনো পর্যটক কক্সবাজার এসে ৩ থেকে ৪দিন অবস্থান করে হোটেল-রেস্তোঁরায় থাকা-খাওয়া এবং অল্পস্বল্প কেনাকাটা ও যানবাহন ভাড়াসহ পযর্টন খাতে প্রতি একজনে ১০ হাজার টাকার ব্যবসা হতে পারে। এই হিসেবে আমরা পর্যটন খাতের লাভ-লোকসানের হিসেবটা করি। এ নিয়ে বলা যায়, গত ১০ দিনে কক্সবাজারের পযর্টন খাতে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমরা সকলেই চাই, কক্সবাজারের পযর্টন খাত দ্রুত সময়ে আবারো চাঙা হোক।’
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :