কর্মজীবীদের জন্য সময় হাতে নিয়ে দূরে কোথাও ভ্রমণে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে চাইলে সাপ্তাহিক ছুটির দিনেই ঢাকার কাছাকাছি গাজীপুরে ঘুরে আসতে পারেন পরিবার নিয়ে। ঢাকার পাশেই গাজীপুরে এমন বেশ কয়েকটি পর্যটন স্থান ও স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো চাইলে আপনি প্রতি সপ্তাহেই ঘুরে আসতে পারবেন।
তাই এক দিনের সময় হাতে নিয়ে যদি গাজীপুরে ঘুরতে যেতে চান, তাহলে জেলার এই ৬টি স্থানে যেতে পারেন।
নুহাশ পল্লী
নুহাশ পল্লী গাজীপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে পিরুজালী গ্রামে অবস্থিত। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ১৯৮৭ সালেনিজের ছেলে নুহাশের নামে এটি গড়ে তোলেন। ২০১২ সালে মৃত্যুর পর এখানেই শায়িত আছেন গল্পের এই জাদুকর। ঢাকা থেকে ৪৪ কিলোমিটার দূরে গাজীপুরে একটি বাগানবাড়ি, নুহাশ চলচিত্রের শুটিং স্পট ও পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র নিয়ে নূহাশ পল্লী। মাঠের মাঝখানে একটি গাছের উপর ঘর তৈরি করা আছে, যা আবাক করবে আপনাকে! হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত বহু নাটক ও চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয়েছে এখানে।
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে পেয়ে যাবেন হোতাপাড়া যাওয়ার বাস। এই বাসে করে চলে যাবেন হোতাপাড়া বাজার। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে হোতাপাড়া বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া ৪০ টাকা। তারপর সেখান থেকে রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক বা সিএনজি করে সোজা নুহাশ পল্লী চলে যাবেন।
নুহাশ পল্লী সকল দর্শনার্থীদের জন্য প্রতিদিন খোলা থাকে। টিকিট মূল্য ২০০ টাকা। তবে ১০ বছরের কম বয়সীদের জন্য টিকিট প্রয়োজন নেই। ডিসেম্বর থেকে মার্চ শুধু পিকনিকের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। এ সময় সাধারণ দর্শনার্থী প্রবেশের সুযোগ নেই। তবে ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী ও ১৯ জুলাই মৃত্যুবার্ষিকীতে নুহাশ পল্লী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
বেলাই বিল
গাজীপুরের কাছেই চেলাই নদীসংলগ্ন বক্তারপুর, বাড়িয়া, ব্রাহ্মণগাঁও ও বামচিনি এলাকা ঘিরে রেখেছে মনোমুগ্ধকর বেলাই বিলকে। বিলটি প্রায় আট কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। তবে বেলাই বিলের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে বর্ষাকাল বেছে নিতে হবে।
গ্রামটির একটি মৌজায় কেবল একটি বাড়ি রয়েছে। বলা যায়, এটি একটি ব্যতিক্রমী বিষয়। বিল দেখা শেষে পাশের কানাইয়া বাজারে বসে এক কাপ গরম চা খেয়ে নিতে পারেন। লম্বা সময় ধরে বিল ভ্রমণ করতে চাইলে সঙ্গে হালকা খাবার নিয়ে যাবেন।
বাসে গাজীপুরের শিববাড়ী মোড়ে নেমে সেখান থেকে রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কানাইয়া বাজারে যেতে হবে। কানাইয়া বাজার ঘাটে বেলাই বিল ভ্রমণের জন্য নৌকা ভাড়া পাবেন। পাশেই ভাওয়াল পরগনা শ্মশানঘাট বা শ্মশানবাড়ি আছে। চাইলে তাও দেখে আসতে পারেন।
ধাঁধার চর
শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত স্থানে সৃষ্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি স্থান ধাঁধার চর। এই চরের পশ্চিমে গাজীপুরের কাপাসিয়া অংশে রয়েছে শীতলক্ষ্যা, পূর্ব পাশে নরসিংদীর মনোহরদী-শিবপুর অংশে ব্রহ্মপুত্র। শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরে দুর্গাপুর-তারাগঞ্জ এলাকায় বর্গিদের আস্তানা ছিল। সেখানে ছিল ইতিহাসের বিখ্যাত দুর্গ একডালা, ফিরোজ শাহের আক্রমণের সময় শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এবং তাঁর ছেলে সিকান্দর শাহ এ দুর্গে অবস্থান নিয়ে দিল্লির সুলতানের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেন। দুর্গাপুরে বাড়িরগাঁও এলাকায় নীলের রস প্রক্রিয়াজাতকরণের চুলা নজরে পড়ে এখনো। নদীর ৫০০ গজের মধ্যে রয়েছে নীলকুঠি। যেখান থেকে বাংলার সাধারণ মানুষকে নীল চাষে বাধ্য করা হতো।
নৌকা আকৃতির প্রায় ২৫০ একর আয়তনের দ্বীপটি বর্ষা ও শীত মৌসুমে স্থানীয় ও দূরদূরান্তের অনেক মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বরই, পেয়ারা, কলাসহ বিভিন্ন ফলবাগান থেকে নিজ হাতে পেড়ে খেতে পারেন। আম-কাঁঠালের সবুজ ছায়া, অবারিত ফসলের মাঠ, পাখির কিচিরমিচির শব্দ, গরমে নদীর হিমেল হাওয়া আপনার শরীর ও মনের ক্লান্তি দূর করবে নিমেষে।
চরটির পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বটতলায় আছে ঐতিহাসিক ঘাঘাট। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অষ্টমী তিথিতে এই ঘাটে পুণ্যস্নান করেন। ধাঁধার চর শুটিং স্পট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। শাবনাজ-নাঈম অভিনীত বিষের বাঁশি চলচ্চিত্রের বেশির ভাগ দৃশ্য এখানেই ধারণ করা হয়।
বেলাই বিল দেখার পর সেখান থেকে পাকা সড়ক ধরে কাপাসিয়া সদরে যাবেন। কাপাসিয়া থেকে যাবেন রানীগঞ্জে। রানীগঞ্জ বাজারের ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে চলে যান ধাঁধার চরে।
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের অবস্থান। প্রায় ৩ হাজার ৬৯০ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে রয়েছে ছোট ছোট টিলা ও শালবন। থাইল্যান্ডের সাফারি ওয়ার্ল্ডের অনুকরণে ২০১৩ সালে এটি গড়ে তোলা হয়। চারপাশে রয়েছে উন্মুক্ত বাঘ, সিংহ, জিরাফ, বন্য হরিণ, জেব্রাসহ নানা প্রাণীর বিচরণ। এর মধ্য দিয়ে বিশেষ গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো আপনাকে অন্যরকম শিহরন এনে দেবে।
ঢাকা থেকে মাত্র ৪৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরে এই পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণিদের বিচরণ দেখতে সারা বছরই দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। এছাড়া এখানে রয়েছে পাখিশালা, প্রজাপতি সাফারি, জিরাফ ফিডিং স্পট, অর্কিড হাউজ, শকুন ও পেঁচা কর্নার, এগ ওয়ার্ল্ড, বোটিং, লেইক জোন, আইল্যান্ড, প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র, ফ্যান্সি কার্প গার্ডেনসহ অনেক বিলুপ্তপ্রায় প্রাণির সমারোহ।
গাজীপুরের বাঘেরবাজার থেকে রিকশা বা অটোরিকশায় করে সহজেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে যাওয়া যায়।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান
গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে অপরূপ বৃক্ষ রাজ্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। ভাওয়াল বনভূমির প্রধান বৃক্ষ গজারি। এ কারণে একে ভাওয়ালের গজারি গড়ও বলা হয়। সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের কারণে বরাবরই জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের পছন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে।
প্রাণীবৈচিত্র্যের দিক দিয়ে এই উদ্যান অনন্য। এখানে একসময় বাঘ, কালো চিতা, চিতাবাঘ, মেছোবাঘ, ময়ূর ও মায়া হরিণের দেখা মিলত। সময়ের পরিক্রমায় সেসব এখন আর তেমন নেই। তবে খ্যাঁকশিয়াল, বাগডাশ, বেজি, কাঠবিড়ালি, গুইসাপসহ কয়েক প্রজাতির সাপের দেখা মেলে এখন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পাশের এই উদ্যানে প্রায় ৬৪ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। যার মধ্যে ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী, নয় প্রজাতির সরীসৃপ, ১০ প্রজাতির উভচর ও ৩৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। উদ্ভিদবৈচিত্র্যের দিক দিয়েও এ বন বিশেষভাবে আলোচিত। এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট। রয়েছে ১৩টি কটেজ ও ছয়টি রেস্টহাউস।
ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি 2০ টাকা। গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকলে নির্দিষ্ট হারে মূল্য পরিশোধ করতে হয়। দোতলা বাস ৪০০ টাকা, বাস ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা, প্রাইভেট কার ৬০ টাকা এবং অটোরিকশা ২০ টাকা।
ভাওয়াল রাজবাড়ী
দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয় একটি স্থাপনা ভাওয়াল রাজবাড়ী। স্থাপত্য বিশারদদের মতে, এটি বাংলাদেশের প্রাচীন সর্ববৃহৎ প্রাসাদ। প্রায় ১৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত মূল প্রাসাদটি উত্তর দক্ষিণে প্রায় ৪০০ ফুট বিস্তৃত। চার কোণে চারটি গোলাকার স্তম্ভ স্থাপন করে ওপরে ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে। ভাওয়াল রাজবাড়ীতে ৩৬৫টি কক্ষ রয়েছে। অনন্য স্থাপনাশৈলীতে তৈরি শাল কাঠের সিঁড়ি, নাট মন্দির, রানী মহল, পদ্মনাভি ইত্যাদি। বর্তমানে গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এ রাজবাড়ীতেই অবস্থিত। তা ছাড়া গাজীপুর আদালতের একটি অংশও এই বাড়িতে পরিচালিত হয়।
দেশের যেকোনো স্থান থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে শিববাড়ী মোড় নেমে রিকশাযোগে রাজবাড়ী যেতে পারেন।
একুশে সংবা//স.টি//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :