র্যাগিং, অডিও ফাঁস ও ছাত্র বহিষ্কারসহ নানা ঘটনায় বছরজুড়ে উত্তাল ছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বছরজুড়ে এসব ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। একইসাথে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নেরও। ক্ষুণ্ন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান, প্রশ্ন উঠেছে কর্তাব্যক্তিদের দিকে।
বিভিন্ন সময় শাখা ছাত্রলীগ কর্মীদের বিতর্কিত কর্মকান্ড ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নিয়োগ সংক্রান্ত অডিও ফাঁসসহ নানা ঘটনায় আলোচনায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। বছরের শুরুতে শাখা ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক নবীন ছাত্রীকে রাতভর বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনার মাধ্যমে আলোচনায় এসে সারা বছর নেতাকর্মীদের বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ডে খবরের শিরোনাম হয় সংগঠনটি। সর্বশেষ নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুলের ড্রাইভার পদে নিয়োগে ছাত্রলীগ সভাপতির টাকা লেনদেন চুক্তির কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনা আলোচিত হয়। এর মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় অডিও কান্ডে। একদিকে ছাত্রী নির্যাতন অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের লাগাতার নিয়োগ সংক্রান্ত অডিও ফাঁসের ঘটনায় বিব্রত পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
বছরের শুরুতেই ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি দুই দফা ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও টেলিভিশন টকশো এর নিয়মিত বিষয় হয়ে ওঠে এটি। সর্বশেষ ঘটনা গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত। এ ঘটনায় ২১ আগস্ট ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ জড়িত অপর চার সহযোগীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়। এদিকে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনার সুরাহা না হতেই ১৯ জুন ছাত্র হলে ফের নবীন ছাত্রকে রাতভর দফায় দফায় নির্যাতন ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে। এতে ওই ছাত্রকে নগ্ন করে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করেন হলের দুই সিনিয়র শিক্ষার্থী। পরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ তুলে নিলে ঘটনা মিমাংসা হয়।
পরে আবারো ২ সেপ্টেম্বর ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের নবীন বরণের দিনই ওই শিক্ষাবর্ষের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক নবীন শিক্ষার্থী বিভাগের কয়েকজন সিনিয়র কর্তৃক র্যাগিংয়ের শিকার হয়। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে জড়িত তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক ও দুইজনকে স্থায়ী বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের রেজওয়ান সিদ্দিকী কাব্যকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। প্রত্যেকটি ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগ কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা মেলে। সবমিলিয়ে বছরজুড়ে ৫ জনের ছাত্রত্ব বাতিলসহ ১১ শিক্ষার্থী বহিষ্কার হয়। সর্বশেষ ২৩ নভেম্বর শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাতের বিশ লাখ টাকায় ড্রাইভার পদে নিয়োগের চুক্তির কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার ঘটনাটিও তুমুল সমালোচিত হয়।
এসব ঘটনার মাঝে আরো বেশ কিছু সমালোচনার জন্ম দিয়েছে অডিও কান্ড। একজন চাকরি প্রত্যাশীর সঙ্গে ভিসি প্রফেসর ড. শেখ আবদুস সালামের নিয়োগ বোর্ড, প্রশ্নপত্র ফাঁস, চাকরির বিনিময়ে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত অন্তত চোদ্দটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এসব অডিওতে ভিসির সঙ্গে চাকরি প্রার্থীর নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলাপন শোনা যায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১৩ জুন পর্যন্ত চারমাস ধরে অডিওগুলো লাগাতারভাবে বিভিন্ন ফেইক ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট হওয়ায় চরমভাবে ইমেজ সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব বিষয়ে খবর প্রকাশিত হলে ক্যাম্পাস জুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে অডিও ফাঁসের ঘটনায় নেপথ্যের মানুষদের খুজতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গোপন রেকর্ডারের মাধ্যমে অডিও ধারণ করা হচ্ছে সন্দেহে ভিসির কার্যালয় ও বাসভবনে গোপন ডিভাইসের খোঁজে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি চালিয়েও কোনো ডিভাইস পাওয়া যায়নি।
একইসঙ্গে এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী অস্থায়ী চাকরীপ্রত্যাশীদের আন্দোলনে ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে। তারা এর প্রতিবাদে ভিসি অপসারণের দাবিতে ভাইরাল হওয়া অডিও মাইকে বাজিয়ে ও ভিসির কার্যালয়ে তালা দিয়ে আন্দোলন করেন। তবে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন হলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ভিসির অডিও ফাঁসের রেশ কাটতে না কাটতেই এর মাঝে ১৪ মার্চ ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসানের অর্থ লেনদেনের কথোপকথন ফাঁস হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় চরমভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ক্ষু্ণ্ন হওয়ায় শিক্ষক সমিতি ও প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠন ‘শাপলা ফোরাম’ থেকে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনায় বিবৃতি দেওয়া হয়। তবে এ ঘটনার কোনো সুষ্ঠু সমাধান না হওয়ায় সময়ের পরিক্রমায় চাপা পড়ে যায়।
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :