বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক সহ ৬টি পদে জনবল নিয়োগে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও চিলারং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: ফজলুর রহমান ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে।
ভূক্তভোগিদের অভিযোগ, সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক ৬টি পদের বিপরীতে ১৫ থেকে ২০ জনের নিকট হতে জনপ্রতি ১৫-২০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিয়োগ দেয় ৬জনকে। এদিকে চাকুরী প্রত্যাশীরা নিয়োগ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে টাকা ফেরতের আশায় দিন গুনছেন।
জানা যায়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারী সহকারী প্রধান শিক্ষক, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর, অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নৈশ প্রহরী ও আয়া পদে জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ঠাকুরগাঁওয়ের পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর স্থানীয়রা চাকুরীর আশায় বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও চিলারং ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের নিকট যোগাযোগ শুরু করেন। এমনকি চাকুরীর আশায় তারা একেকজন বাড়ীর পোষা গরু, বোরো রোপন অবস্থায় জমি বিক্রিসহ ধার-মাহাজন করে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ জোগাড় করে পাহাড়ভাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ও প্রধান শিক্ষক কফিল উদ্দিনের কাছে জমা দেন।
নিয়ম মোতাবেক ঠাবুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজে নিয়োগ পরীক্ষাও হয়। যারা চাকুরীর জন্য টাকা জমা দেন, তাদের পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্রও দিয়ে দেয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু প্রশ্নপত্র পেয়েও চাকুরী পাননি অনেকে। তাদের অভিযোগ সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক যোগসাজেশ করে যারা বেশি টাকা দিয়েছে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন।
কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদে আবেদনকারি সুমি আক্তারের স্বামী মোঃ সোহাগ জানান, বিদ্যালয়ের সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কথামতো চেয়ারম্যানকে ৮ লাখ টাকা ও প্রধান শিক্ষককে ৪ লাখ টাকা দিয়েছি। চুক্তি মোতাবেক পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্রও দেয় প্রধান শিক্ষক, আমার স্ত্রী পরীক্ষাও ভালো দেয় (যেহেতু প্রশ্নপত্র আগেই পেয়ে গেছে), কিন্তু রেজাল্টে দেখা যায় আমার স্ত্রীর নাম নেই। পরে জানতে পারি আমার স্ত্রীর পদে ১৯ লাখ টাকা নিয়ে নিয়োগ দেন তারা। আমি এ নিয়োগ বাতিলসহ পুণরায় নিয়োগ পরীক্ষার দাবি জানাই। তা নাহলে আমরা নিয়োগ বঞ্চিতরা মানববন্ধনসহ কঠোর কর্মসুচি পালন করবো।
তিনি আরও জানান, নিয়োগ বঞ্চিত ৯ জনের নিকট থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চেয়ারম্যান ও প্রধান শিক্ষক।
খাদেমুল ইসলাম নামে এক ভূক্তভোগি জানান, তার বাবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে নৈশ প্রহরীর কাজ করে। সেই সুবাদে সেও এই চাকুরীর আশায় দরখাস্ত করে। পরে ওই পদে চাকুরীর জন্য চেয়ারম্যান ৫ লাখ ও প্রধান শিক্ষক ৩ লাখ টাকা চায়। কষ্ট করে টাকাও জোগাড় করে জমা দেয় তার পরিবার, কিন্তু তার চাকুরী হয়নি।
বাবুল হক নামে আরেক ব্যক্তি জানান, নৈশ প্রহরী পদে তার ছোট ভাই সোহেল রানার চাকুরীর জন্য হালের গরু বিক্রি করে, জমি বন্ধক দিয়ে ও সুদের উপর টাকা নিয়ে বিদ্যালয়ের সভাপতি ও চেয়ারম্যানের চাহিদা মতো ১২ লাখ ও হেডমাষ্টারকে ২ লাখ টাকা দিলেও করলেও তার ছোট ভাইয়ের চাকুরী হয়নি। তিনি এ অন্যায়-অবিচারের ন্যায় বিচার দাবি করে প্রদানকৃত টাকা ফেরতের দাবি জানান।
শাহানাজ পারভীন নামে এক প্রতিবন্ধী নারী জানান, স্কুলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কথা জানতে পেরে আয়া পদে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এখানে যেভাবে টাকার খেলা হয়েছে, তাতে আমার মতো গরীবের চাকরী নাই। এখানে যে বেশি টাকা দিতে পেরেছে তার চাকরী হয়েছে, টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র আগেই ফাঁস হয়েছে। আমার টাকা নাই, এজন্য আমার চাকরীও নাই। এভাবেই যদি দেশ চলে, তাহলে আমার মতো গরীব মানুষ কোনদিন চাকুরী পাবে না।
তবে টাকা-পয়সা লেন-দেন এর বিষয়টি সম্পুর্ণরুপে অস্বীকার করেছেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: কফিল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘টাকা যদি কেউ দিয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে দিলো, কেমন করে দিলো, কার মাধ্যমে দিলো এসবের সঠিক প্রমাণাদি দিতে হবে। যদি দিতে পারে তবে তিনি তখন বিষয়টি দেখবেন, তার আগে নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি বিদ্যালয়ের সভাপতি টাকা নিয়ে থাকেন তবে এর জবাবদিহি সভাপতি দিবেন। বিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র হাতে লিখে দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রথমে বলেন নিয়োগ বোর্ড জানেন, পরে তিনি স্বীকার করেন প্রশ্নপত্র হাতে লিখে দেওয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগের রাতে প্রার্থীদের প্রদান করা হয়েছিলো কি না-এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এর সদূত্তর দিতে পারেন নি।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে বিদ্যালয়ের সভাপতি ও চিলারং ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ফজলুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনিও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলেন, কে কিভাবে কি কারণে টাকা দিয়েছে তার যথোপযুক্ত প্রমাণাদি দিলে তিনি অবশ্যই টাকা ফেরত দিবেন।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুর রহমান জানান, যদি নিয়োগে অনিয়ম ধরা পড়ে সেক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
একুশে সংবাদ/বি.ধা.প্রতি/এসএপি
আপনার মতামত লিখুন :