আইনি কোন বাধাঁ নেই, তার পরেও কোন বাধাঁ বিপত্তি না থাকলে আজ রাতেই ফাঁসি কার্যকর হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী ৪নং আসামি ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের। তবে শেষ মুহুর্তেও তার শতবর্ষী বৃদ্ধা মা সেতারা বেগম জানেন না তার ছেলের ফাঁসির খবর।
এদিকে, স্বজনদের সাথে শেষ সাক্ষাতের সময় নিজেকে ন্যায় বিচার বঞ্চিত দাবি করে স্ত্রীকে দেশের সহায়সম্পত্তি বিক্রি করে সন্তানদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার কথা জানান বলেও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।
অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলার ৪ নং আসামি ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দি গ্রামে। তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরে গ্রামের মানুষও হতবম্ব। একজন সুশিক্ষিত ও ভালো মানুষ হিসেবেই গ্রামবাসী জানেন।
জান্দি গ্রামে ড. মহিউদ্দিনের পৈত্রিক বাড়িতে বৃদ্ধা মা ব্যতিত তার দুই ভাই, চাচাতো ভাইয়েরা বসবাস করেন। তার শতবর্ষী বৃদ্ধা মা কানে একদমই শুনেন না। তিনি এখনো জানেনই না যে তার ছেলের ফাঁসি হচ্ছে। পরিবারের কেউ তাকে কিছু জানায়নি। বাড়িতে কোন সংবাদকর্মী বা কোন আত্মীয়স্বজনের সমাগম দেখলেই তিনি জানতে চাইছেন আগমনের হেতু। গত ১৭ বছর তার সাথে দেখা নেই ছেলের। এমনকি তার ছেলে যে একটি হত্যা মামলার আসামি তাও জানেন না।
ভাঙ্গার জান্দি গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা ও ছোট ভাই আরজু মিয়া ছাড়াও বোন রিনা বেগম এবং দুজন চাচাতো ভাই ছিকু মিয়া শাহীন মিয়া বসবাস করেন। বাড়িতে যেয়ে দেখা যায়, পরিবারের লোকজন স্তব্ধ হয়ে আছেন।
চাচাতো ভাই ছিকু মিয়া জানান, তারা ড. মহিউদ্দিনের সাথে মহিউদ্দিনের স্ত্রী, ভাই আরজু মিয়া, বোন রিনা বেগম, ছিকু মিয়া ও আরেক শাহীন মিয়া গত মঙ্গলবার দুপুরে শেষ দেখাটি দেখা করেন।
দেখা হলে কি কথা হয়েছে সে সম্পর্কে ছিকু আরো জানান, অধ্যাপক তাহের ছিলেন আমার বাবার সমতুল্য। তিনি আমাকে হাতে ধরে মানুষ করেছেন। প্রায়ই আমি তার বাজার ঘাট করে দিতাম।
শেষ কথা আরো কি হয়েছে জানতে চাইলে ছিকু মিয়া বলেন, তার চাচাতো ভাই ড. মহিউদ্দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি ন্যায় বিচার পেলেন না এবং আল্লাহর কাছে এর বিচার দিয়ে গেলাম বলে তাদের বলেছেন। আর তার স্ত্রীকে বলেছেন, যেহেতু এদেশে ন্যায় বিচার পেলাম না, তাই জায়গাজমি বিক্রি করে ছেলেমেয়ে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যেও।
মহিউদ্দিনের ছোট ভাই আরজু মিয়া বলেন, আমরা আওয়ামী পরিবারের সন্তান। আমার ভাই মামলার ৪ নম্বর আসামি ছিলেন। মামলায় প্রথম ও দ্বিতীয় আসামি খালাস পেলো অথচ আমার ভাইয়ের ফাঁসি বহাল থাকলো। তিনি বলেন, বড় ভাইয়ের ফাঁসির খবর শুনলে মা স্ট্রক করতে পারেন এ আশঙ্কায় তাকে কিছুই জানানো হয়নি।
আরজু বলেন, আমার বড় ভাই নির্দোষ ছিলেন বিধায় মামলা সম্পর্কে কোন গুরুত্ব দেননি। বড় ভাই ভেবেছিল অন্যায় করিনি। ইনশাআল্লাহ খালাশ পাবো। আমার ভাই রোষানলে পড়ে ফাঁসি হলো। আমার ভাইয়ের বিচার পরকালে পাবো।
তিনি আরো বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে একটা চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি বাড়ি নিয়ে খুলতে বলেছিলে। আমরা গাড়ির মধ্যেই চিঠি খুলে দেখেছি তাতে লেখা রয়েছে ২৭-৭-২০২৩ বৃহস্পতিবার রাত দশটা এক মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হবে। আমরা লাশ অ্যাম্বুলেন্সে পাঠিয়ে দিব, আপনারা শুধু এম্বুলেন্সের ভাড়া দিয়ে দিয়েন। স্বজনরা জানান, জানাযা বাড়ীর মসজিদে এবং জুমার নামাজের আগেই দেয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
ওই গ্রামের প্রায় পচাত্তর বছর বয়সি বৃদ্ধা হাসিনা বেগম বলেন, মহিউদ্দিন মিয়াকে আমরা গ্রামে বলি সূর্য মিয়া। তার মত একজন ভদ্র ছেলে আমাদের গ্রামে নাই। গ্রামের আরেক যুবক রনি মিয়া বলেন, আমরা শুনেছি মহিউদ্দিন চাচা জাপান, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশুনা করে সোনার মেডেল পেয়েছেন। তিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তার মত এমন লোক আর আমাদের এলাকায় হবে না।
ব্যক্তিজীবনে ইয়াফিক ও ইউসি নামে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ড. মিয়া মহিউদ্দিন। তার বাবা মৃত আব্দুল মান্নান মিয়া খুলনা জুট মিলে চাকরি করতেন। ১৯৮১ সালে তিনি ভাঙ্গা কেএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনিবদ্যা বিষয়ে ভর্তি হন। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে।
একুশে সংবাদ/স.শ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :