গতবছরের এই সময়ে ধানে কীটনাশক দেয়ার সময় রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন কৃষক রুহুল আমিন। গুরুতর আহত অবস্থায় অন্যান্য কৃষকরা তাকে উদ্বার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও জমিতে ফিরতে সময় লেগেছে প্রায় বছরখানেক। এরমধ্যে সাপের আতঙ্কে প্রায় ১২ বিঘা জমির ১০ বিঘায় চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন পায়ে জুতা পরে কাজ করেন কৃষিজমিতে। তবুও ভয় পিছু ছাড়ছে না তার।
শুধুমাত্র কৃষক রুহুল আমিনই নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা ভুগছেন রাসেল ভাইপার আতঙ্কে। রাসেল ভাইপার সাপের উপদ্রব বাড়ায় আতঙ্কে দিন পার করছেন কৃষকরা। সাপের কারনে পাঁকা আমন ধান কাটার জন্য পাওয়া যাচ্ছে না ধানকাটা শ্রমিক। এতে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা কৃষকদের। শুধু ধানকাটায় নয়, সাপের ভয়ে ধানে ঠিকমতো পরিচার্যাও করতে পারছেন না তারা।
কৃষকদের দাবি, গতবছর থেকেই ধানের জমিতে ব্যাপকহারে বাড়ছে রাসেল ভাইপার সাপের উপদ্রব। প্রায় প্রতিনিয়ত দেখা মিলছে বিষধর এই সাপের। সাপের কামড়ে আহত-নিহতের ঘটনা ঘটছে মাঝেমধ্যেই।
কেন্দুয়া গ্রামের কৃষকদের দাবি, ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র এই গ্রামেই রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে মারা গেছেন ৬ জন কৃষক। আহত হয়েছেন আরও অনেকেই। সাপের উপদ্রব বাড়ায় ধান কাটতে আসতে চাইছেন না শ্রমিকরা। যারা কাটছেন, তারা রয়েছেন ব্যাপক ভয় ও নিরাপত্তাহীনতায়।
কৃষক রুহুল আমিন বলেন, জমিতে কীটনাশক দেয়ার সময়ে হঠাৎ রাসেল ভাইপার সাপে কামড় দেয়। কামড় দেয়ার পরপরই রক্ত বের হতে থাকে। পরে আশেপাশের কয়েকজন কৃষক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এমনকি হাসপাতালে ভর্তির পর চতুর্থ তলায় নিয়ে যায়। এরমধ্যে আমার কোন জ্ঞান ছিল না। সুস্থ হওয়ার পর ভয়ে জমিতে আসতে পারছিলাম না। এখন ভয়ে ভয়ে আসছি গামবুট পরে।
নেজামপুর ইউনিয়নের কেন্দুয়া গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম জানান, পাঁকা ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে কেউ ধান কাটতে না আসলে সবই শেষ হয়ে যাবে। গতবছর থেকে সাপের উপদ্রব বাড়ার কারনে শ্রমিকরা এমন কাজ করতে চাই না। ফলে কেন্দুয়া, রাওতারা, চন্ডিপুর মাঠে আসতে চাই না শ্রমিকরা।
ষাটোর্ধ আমজাদ আলী বলেন, আমার জমিতে গত এ সপ্তাহের মধ্যেই তিনটি রাসেল ভাইপার সাপ মেরেছি। কয়েকদিন আগেও চন্ডিপুর গ্রামে এক কৃষককে সাপে কামড় দেয়। পরে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর সুস্থ হলেও আশেপাশে জমির কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে। জমিতে আসতে ভয় করছে। জমিতে সেচ ও সার দিতে পারছি না ঠিকমতো। কৃষক মাহিদুল ইসলাম তার জমিতে রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে আহত এক কৃষককে হাসপাতালে চিকিৎসা দেন। তিনি জানান, সাপের কামড়ে আহত হওয়ার পর তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন।কিন্তু তার কয়েকদিন পরেই আরেকজন সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে আমার জমিতে সকল শ্রমিককে পায়ে জুতা দিয়ে কাজ করায়।
গোমস্তাপুর উপজেলার আড্ডা এলাকার বাসিন্দা ও ধানকাটা শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর ধরে আমরা নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের জমির ধান কাটি আমরা। কিন্তু গতবছর থেকে প্রচুর রাসেল ভাইপার সাপের উপদ্রব বাড়ায় ভয়ে ভয়ে কাজ করছি। কি আর করার পেটের দায়ে জীবন বাজি রেখে কাজ করতে হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে কাজ করছি, কখন কোনদিক থেকে সাপ এসে কামড় দেয়।
রাওতারা গ্রামের কৃষক সাদিকুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে জমি চাষাবাদ করি। দীর্ঘ এই সময়ে জমিতে অনেক সাপ দেখেছি ও মেরেছি। কিন্তু রাসেল ভাইপার সাপটি একবারেই আলাদা। এই সাপ প্রচুর পরিমাণে বিষধর। কামড়ালে খুব কম সময়ের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তি মারা যায়। ধানগাছের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। মানুষের উপস্থিতি টের পেলেই কামড় দেয় রাসেল ভাইপার সাপ।
কৃষিতে অধিকহারে যান্ত্রিকীকরণ ও উপজেলা পর্যায়ে এ্যান্টিভেনম সরবরাহসহ সুচিকিৎসা প্রদানকেই সংকট সমাধানের উপায় বলছেন কৃষক নেতারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, এবিষয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার। কৃষি বিভাগের তত্বাবধানে বনবিভাগের সহযোগিতায় জনবহুল ও ফসলী জমি থেকে এই সাপ সরাতে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সাপের সংখ্যা বেড়েছে, ফলে কৃষকদের সচেতনতার পাশাপাশি জিন্স কাপড় ও জুতা পরে ধান কাটার পরামর্শ কৃষি বিভাগের। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. পলাশ সরকার বলেন, কৃষকদেরকে সচেতন করা হচ্ছে কৃষি কাজ করার সময়ে সর্তক থাকার জন্য। এছাড়াও মসজিদে মসজিদে মাইকিং করে সর্তক থাকতে বলা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন ডা. এসএম মাহমুদুর রশিদ বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে এ্যান্টিভেনম সরবরাহ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সাপের কামড়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। তাই কৃষক ভাইদের সর্তক থেকে কাজ করতে হবে এবং সাপে কাটা মাত্রই নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যা কমপ্লেক্সে নিয়ে যেতে হবে।
চলতি আমন মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৫৩ হাজার ৫৫৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫৩ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে ধান চাষাবাদ হয়েছে।
একুশে সংবাদ/এস কে
আপনার মতামত লিখুন :