উৎসব মুখর পরিবেশে রাঙামাটি রাজবন বিহারে বৃহস্পতিবার থেকে ৪৮তম দানোত্তম কঠিন চীবর দনোৎসব শুরু হয়েছে। আজ বিশ্বপ্রাণীর সুখ, বিশ্ব মানবতার কল্যাণ ও বিশ্বশান্তি কামনায় দানোৎসর্গ করা হবে। কঠিন চীবর-কল্পতরুসহ বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী।
বৃহস্পতিবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে বেইনঘর ও চরকীতে সুতাকাটা উদ্বোধন করে দুদিনব্যাপী দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবের সুচনা করা হয়।
২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা বের করে সেই সুতা রং করে কাপড় বুনে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র চীবর দান করা হয়। কঠিন চীবরের পাশাপাশি বুদ্ধমুর্তি দান, সংঘ দান, অষ্ট পরিষ্কার দান, হাজার প্রদীপ দান, আকাশ প্রদীপ দান, কল্পতরু দান ইত্যাদি নানাবিধ দান করা হয় দানোত্তম কঠিন চীবর দানের দিন। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রত্যেক বছর হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় রাঙামাটি রাজবন বিহারে। দেশ-বিদেশের শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষু ও উপাসক-উপাসিকারা মিলিত হন দানোৎসবে।
রাঙামাটি রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সভাপতি গৌতম দেওয়ান জানান, এ বছর ভারতের মহারাষ্ট্র থেকে ৭৬জনসহ আমেরিকা, থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকা থেকে বহু পুণ্যার্থী রাঙামাটি রাজবন বিহারের ৪৮তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করছেন।
রাঙামাটি রাজবন বিহার উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমিয় খীসা বলেন- বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চশীল গ্রহেনর পর বেইনঘর উদ্বোধন করেন রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালংকার মহাথেরো। বেইনকর্মীদের সঙ্গে সুতাকাটা উদ্বোধন করেন রাঙামাটির বিশিষ্ট নারী উদ্যোক্তা মঞ্জুলিকা খীসা। এবারের কঠিন চীবর প্রস্তুত করার জন্য ২০৫টি বেইন বুনা হয়। প্রতিটি বেইনে ৪জন বেইনকর্মী বুনন কাজ করেন। অনুষ্ঠানে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ৫ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত রয়েছে।
আজ মুল অনুষ্ঠানের আগে সকালে প্রথমপর্বে সংঘদান,অষ্ট পরিস্কার দান, সদ্ধর্ম দেশনা ও ভিক্ষুসংঘকে পিন্ডুদানের পর দুপুরে কঠিন চীবর ও কল্পতরু শোভাযাত্রা শুরু হবে। বেইনঘর থেকে কঠিন চীবর ও কল্পতরু শোভাযাত্রা সহকারে বিহার এলাকা প্রদক্ষিণ করে রাজবন বিশ্বশান্তি প্যাগোডার পাশে বড় মাঠে অনুষ্ঠান মঞ্চে নিয়ে আসা হবে। অনুষ্ঠানে কঠিন চীবরটির সঙ্গে বুদ্ধমুর্তি দান, অষ্ট পরিষ্কার দান, কল্পতরু দান, রাজবন বিশ্ব শান্তি প্যাগোডা নির্মাণে টাকাসহ বিভিন্ন দানীয় সামগ্রী দান করবেন পুণ্যার্থীরা। এছাড়া থাকবে ভিক্ষুসংঘের সদ্ধর্ম দেশনা, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও অতিথিদের ধর্মীয় ভাষণ।
রাঙামাটি রাজবন বিহার সুত্র জানায়- রাঙামাটি রাজবন বিহারে এবছর কঠিন চীবর দানোৎসবে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ লক্ষ টাকা। কঠিন চীবর দানোৎসব উদযাপন উপলক্ষে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে রাঙামাটির সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদার, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান সুপ্রদীপ চাকমা, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মোঃ মোশাররফ হোসেন খান, পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানের সার্বিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সতর্ক রয়েছে পুলিশ। রাঙামাটি কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরিফুল আমিন বলেন- রাজবন বিহারের কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় ৩’শ পুলিশ মোতায়েন আছে।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দনোত্তম কঠিন চীবর দান শুরু হয় প্রবারণা পুর্ণিমার পর থেকেই। একমাস ব্যাপী বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে চলে কঠিন চীবর দান। এবছর কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু হয়েছে ২৬ অক্টোবর থেকে। শেষ হবে আগামী ২৬ নভেম্বর। আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ জীবিতকালে তারই এক অনুসারী মহা উপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা বের করে কাপড় তৈরি করে তা থেকে ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র চীবর প্রস্তুত করে দান করেন। এ দানের ফল কখনো ক্ষয় হয় না শীলাখন্ড বা পাথরের চেয়েও কঠিন বলে বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থে উল্লেখ আছে। এ কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এ দানের নাম দিয়েছেন কঠিন চীবর দান।
পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবদন্তী বৌদ্ধ সাধক মহাত্যাগী শ্রীমৎ সাধনানন্দ মহাথেরো বনভান্তে ১৯৭৪ সালে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার তিনটিলা এলাকার শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকা ও উপাসক-উপাসিকাদের দিয়ে দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠানের পুনঃপ্রবর্তন করান। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে পালন করে আসছেন পাহাড়ের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :