মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভৈরবগঞ্জ বাজারের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া মাদানিয়া ক্বাওমিয়া শেখবাড়ি মাদরাসার বার্ষিক ইসলামী মহাসম্মেলন এবং আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ইসলাহি জোড়ে আমীরে আঞ্জুমানে বরুণার পীর শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতি রশিদুর রহমান ফারুক বলেছেন-ঐক্য মুসলমানদের বড় শক্তি। মতভেদ আর দলাদলি পরিহার করে ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে সবাইকে এক হতে হবে। মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন শক্তি পরাজিত করতে পারবেনা। আমাদের অনৈক্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঐক্যতার মূল ভিত্তি হল অহংকার, গর্ব, হিংসা পরিহার করা ও পীর বুজুর্গ আলেম ওলামাদের সামনে রেখে ইসলামের কাজকে এগিয়ে নেয়া।
শ্রীমঙ্গলের ভৈরবগঞ্জ বাজারের উত্তরে মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত শেখবাড়ি জামিয়ার মহাসম্মেলন ও আঞ্জুমানের কেন্দ্রীয় জোড়ে এসব কথা বলেন তিনি। আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম ও শেখবাড়ি জামিয়ার মহাসম্মেলনে কোরআন ও হাদিসের বাণী শোনার জন্যে দূর-দূরান্ত থেকে শেখবাড়ি জামিয়ার বিশাল মাঠে ছুটে আসেন বিপুল সংখ্যাক
ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। শত শত গাড়ীর বহরে যানজটে রূপ নেয় ভৈরবগঞ্জ বাজারের মহাসড়ক। কেন্দ্রীয় জোড় ও শেখবাড়ি জামিয়ার সম্মেলনের বিশাল মাঠে প্রায় লক্ষাধিক মুসল্লির শৃঙ্খলার জন্য হাজারখানেক স্বেচ্ছাসেবক টিম এবং নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন তৎপর। এছাড়াও জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ছিল অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প।
সম্মেলন ও কেন্দ্রীয় জোড় উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শেখবাড়ি মাদরাসার আল ফারুক ছাত্র সংসদ ও বাংলা সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা আরবি ও বাংলা দেয়ালিকা প্রকাশসহ চারু-কারুর মাধ্যমে পুরো মাদরাসা ক্যাম্পাসটি সুসজ্জিত করেন। তাদের এসব সৃজনশীল কার্যক্রম ও প্রকাশনী দেখে মাহফিলে আগত অতিথিসহ মুসল্লিরা বেশ মুগ্ধ হয়েছেন। মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের সুশৃঙ্খলিত ব্যবস্থাপনা ছিল বেশ প্রশংসনীয়।
দুই দিনব্যাপী জোড় ও মাহফিলে ধারাবাহিক ইসলাহি বয়ান, কুরআন তিলাওয়াত ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জিকির আসকারসহ বিভিন্ন ইবাদত বন্দেগিতে শেখবাড়ি মাদরাসা ময়দান এক পবিত্র পুণ্যভূমিতে পরিণত হয়।
সম্মেলনে বয়ান পেশ করেন আমীরে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতি রশিদুর রহমান ফারুক বর্ণভী, বরুণা মাদরাসার সদরে মুহতামিম হাফিজ মাওলানা সাইদুর রহমান বর্ণভী, মাওলানা ওলিউর রহমান বর্ণভী, বরুণা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা শেখ বদরুল আলম হামিদী, মুফতি জসীম উদ্দীন চট্টগ্রাম, মাওলানা মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমি, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, মাওলানা জুনাইদ আল হাবিব, মাওলানা সিবগাতুল্লাহ নূর বি-বাড়িয়া, মাওলানা মমতাজ উদ্দিন বড়দেশী, লেখক গবেষক মাওলানা মুসা আল হাফিজ, মাওলানা আবদাল হোসেন খান, অধ্যাপক মাওলানা আব্দুস সবুর, শেখবাড়ি জামিয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল হাফিজ মাওলানা শেখ আহমদ আফজল বর্ণভী, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম কাসেমী, মাওলানা আব্দুল কাদির বাগরখালী, মাওলানা শামসুল হক সরাইলী, মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম, মাওলানা আব্দুল খালিক চলিতাতলী, মুফতি আবু তাহের জিহাদী, মুফতি আব্দুর রহমান জিহাদী, মুফতি আব্দুল্লাহ ফিরোজী, মুফতি মুজিবুর রহমান ফয়জী, মুফতি আব্দুল লতিফ ফারুকী, হাফিজ মাওলানা সাদ আমীন বর্ণভীসহ অর্ধশতাধিক দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী চিন্তাবিদগণ।
অন্যান্য আলেমরা বলেছেন-পরকালে মুক্তির জন্য পরিশুদ্ধ ইসলামী জ্ঞান চর্চার বিকল্প নেই। ইসলামী শিক্ষা বঞ্চিতরাই আজ সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যৌতুক, সুদ, ঘুষসহ যাবতীয় অনাচার ও বহুমুখী অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। দ্বীনি শিক্ষার অভাবে সমাজে বিদআত ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ছে। এতে লাভবান হচ্ছে ধর্মের লেবাসধারী এক শ্রেণীর ভন্ড পীর ও প্রতারক গোষ্ঠী। তারা সাধারণ মুসলমানদের ঈমান হরণ করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুঁলে কলা গাছ বনে যাচ্ছে। আর তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নষ্ট হচ্ছে মুসলমানদেরর মহামূল্যবান ঈমান। তাই গ্রামে গ্রামে কুরআনী মক্তব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভ্রষ্টতার পথ থেকে মুসলিম জাতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে।
মাওলানা সাইদুর রহমান বর্ণভী বলেছেন, ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়ার কারণেই মুসলমানগণ নানা দুর্দশার শিকার হচ্ছে। সঠিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল ইহকালে কল্যাণ ও পরকালে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বিশ্ব মুসলিমের শান্তি ও নিরাপত্তার পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বভাবের ইতিবাচক পরিবর্তন। আর এটা হবে মানুষের মধ্যে খোদা-ভীতি আর তাকওয়া এসে গেলে। মানুষের দরজায় দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে। মুসলমানের ঈমানকে জাগিয়ে তুলতে পারলে সারা বিশ্বের শাসন ক্ষমতা আবারও ফিরে আসবে মুসলমানের হাতে।
মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজি বলেছেন, নাস্তিক-মুরতাদসহ ইসলামবিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
মাওলানা ওলিউর রহমান বর্ণভী বলেছেন, নবীজীর (স.) সুন্নাতের বিপরীতে মানবতার শান্তি নেই। ক্ষনস্থায়ী এই মানবজীবনে ইহকালে কল্যাণ ও পরকালে মুক্তি অর্জনের লক্ষে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানকে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য আত্মনিয়োগ করা উচিত। দুনিয়াবী লোভলালসার উর্ধ্বে উঠে ইবাদত বন্দেগী করতে হবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অল্প সময়ের জন্য মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাই এ সময়কে আখেরাতের কাজে লাগিয়ে মুত্তাকী বনে সমাজে ভাল কাজ করে মহান আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) এর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।
দিবারাত্রব্যাপী অনুষ্ঠিত ইসলামী মহাসম্মেলনে দেশবরেণ্য আলেম-ওলামাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিপুল মানুষ অংশগ্রহণ করেন।
শুক্রবার শেষরাতে দেশ-জাতির শান্তি-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনার মধ্যদিয়ে সম্মেলনের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। মহাসম্মেলনে বিশেষ দোয়া পরিচালনা করেন শেখবাড়ি জামিয়ার মুহতামিম, আমীরে আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম, শায়খুল হাদিস আল্লামা মুফতি রশিদুর রহমান ফারুক বর্ণভী।
সিলেট বিভাগের বরেণ্য বুজুর্গ, শায়খুল আরব ওয়াল আজম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) এর খলিফা, আল্লামা শায়খ লুৎফুর রহমান বর্ণভীর (রহ.) এর দোয়ার ফসল শেখবাড়ি জামিয়া।
প্রসঙ্গত, আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার খ্যাতিমান বুযুর্গ খলীফায়ে মাদানী কুতুবে দাওরান হযরত মাওলানা শায়খ লুলুৎফুর রহমান বর্ণভী (রহ.) এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।
আপনার মতামত লিখুন :