দেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম শস্যভান্ডার হিসাবে খ্যাত জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা। এই উপজেলায় একসময় চাতাল ব্যবসা ছিল জমজমাট।হাসকিং মিলের মালিক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত পাঁচশিরা বাজারসহ আশপাশের এলাকা। চড়া হারে নেওয়া ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় হাসকিং মিলের বেশির ভাগই এখন বন্ধ। এরইমধ্যে খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহ না করায় কালাইয়ের একশো ছেচল্লিশ চালকল মালিক সরকারের কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। সেজন্য কোনো কোনো চালকল মালিক চাতালে গাড়ির গ্যারেজ ও অন্য কাজের জন্য ভাড়া দিয়েছেন। আবার ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য চাতাল বন্ধ রেখে দাদন ব্যবসা করছে অধিকাংশ চাতাল ব্যবসায়ী।
উপজেলার খাদ্য অফিস সূত্রে জানা গেছে,আশির দশকের শুরুতে ব্যবসায়ীরা কালাই সদরসহ পাঁচটি ইউনিয়নে বেশকিছু হাসকিং চাতাল মিল তৈরি করে চালের ব্যবসা শুরু করে। সেই সময় থেকেই রমরমা ব্যবসা হওয়ার সুবাদে ব্যবসায়ীরা পর্যায়ক্রমে উপজেলায় প্রায় ২৫০টি সরকারি লাইসেন্সভুক্ত চাউল কল গড়ে উঠে।এই চাতালগুলোতে যে পরিমাণ চাল উৎপাদন হতো তা দিয়ে এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হতো। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী যেমন তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে লাভবান হতো তেমনি এই চাতালগুলোতে সৃষ্টি হয়েছিল শত শত দরিদ্র নারী-পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান।এর সঙ্গে সম্পৃক্ত চাল ব্যবসায়ী ও মালিক-শ্রমিকদের অনেকেই দারিদ্রতা জয় করে পুঁজিপতি বনে গেছেন। কিন্তু ব্যাংক ঋণের চাপে ও আধুনিকতার উৎকর্ষে অটো রাইস মিলের দাপটে বাজারে টিকতে না পারার কারণে পুঁজি হারিয়ে সেই সুদিন এখন দুর্দিনে পরিণত হয়েছে।অনেক মিল মালিকরা এই ব্যবসায় অধিক পরিমাণ পুঁজি হারিয়ে চালের মত সুনাম খ্যাত ব্যবসা ছেড়ে নিঃস্ব হয়েছেন।
বন্ধ হওয়া চালকল মালিকদের সাথে আলাপ কালে জানা যায়,বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চালকল ব্যবসা শুরু করে।কিন্তু বাজারে ধান-চালের দাম দফায় দফায় উঠা-নামার কারণে এবং ব্যাংক ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় কালাই উপজেলার বেশিরভাগই হাসকিং রাইস মিলগুলো এখন বন্ধ। ৪০ বছর আগে এই উপজেলায় ছোট-বড় প্রায় দুই পঞ্চাশটি তালিকাভুক্ত হাসকিং মিল চালু ছিল।এখন সর্বসাকুল্যে আশিটি মিল চালু আছে।যেগুলো চালু রয়েছে এগুলোর অবস্থাও খুবই নাজুক।ব্যাংক ঋণ ও দায়দেনায় এসব মিল মালিকরাও জর্জরিত।
পৌর এলাকার চালকল মালিক সোহেল তালুকদার বলেন,অটো রাইস মিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হাসকিং মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।ব্যবসায় লোকসানের ফলে তারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে কেউ কেউ ঋণখেলাপি হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন।
চালকল মালিক রাজা মিয়া বলেন, একসময়ে বিপুল হাসকিং মিল থাকলেও এখন কমে আশিতে দাঁড়িয়েছে।মিলমালিকরা পুঁজি হারিয়েছেন। মিলের যন্ত্রাংশ ও জমি বিক্রি করে কেউ কেউ ব্যাংক ঋণ শোধ করেছেন।অটোরাইস মিলের সাথে প্রতিযোগিতায় হাসকিং মিলগুলো টিকে থাকতে না পেরে অনেকেরই চাউলকল বন্ধ হয়ে গেছে।
উপজেলার চালকল মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিজ বলেন, ধান ও চালের দামে অসামঞ্জস্যতার কারণে খাদ্যগুদামে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চাল সরবরাহ না করায় একশো ছেচল্লিশটি চালকল কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। ফলে ক্রমাগত লোকসানের কারণে পুঁজি হারিয়ে মিল মালিকরা মিল বন্ধ করে দিয়েছে।বর্তমানে আশিটি চালকল চালু রয়েছে।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু সালেহ মোহাম্মদ ইমরান জানান,অটো রাইস মিলের চালের মানের সঙ্গে হাসকিং মিলের তৈরি চাল কিছুটা নিন্মমানের হওয়ায় চলমান বাজারে টিকতে পারছে না।বর্তমান ধানের বাজার মূল্যের সঙ্গে চালের দামের সমন্বয়হীনতার কারণে ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান দেখা দেয়।যার কারণে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে লোকসানে পড়ার কারণে তাই আস্তে আস্তে চাতাল ব্যবসায়ীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :