কোন কায করতে হবে না, শুরু অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মাসে পাওয়া যাবে ১১ হাজার ২০০ টাকা। হিসেব দেখা যাবে মোবাইল অ্যাপে, আর ব্যাংকে রেমিটেন্স আকারে প্রতিমাসে ঢুকবে লাভের টাকা। এমন চটকদার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহী। যদিও এর আগেও এমন ঘটনা ঘটে সেখানে।
‘ইউএস এগ্রিমেন্ট’ নামের এই অ্যাপ এমন চটকদার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় দুই হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে এবার হাতিয়ে নিয়েছে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা।
বিনিয়োগের টাকা যে কোনো সময় তুলে নেয়া যাবে, শুরুতে এমন কথা বলা হলেও কেউ একটি টাকাও ফেরত পাননি। এর আগে গত দুই বছরে এমটিএফই, ই-মুভি প্ল্যানসহ কয়েকটি বিদেশি অ্যাপ দেশে গ্রাহক তৈরি করে এভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, এসব অ্যাপ ছিল বিদেশি। তবে ইউএস এগ্রিমেন্টের গ্রাহকেরা বলছেন, এটি দেশি প্রতারক চক্রের তৈরি একটি অ্যাপ। এর নেতৃত্বে ছিলেন দেশেরই কয়েকজন। অ্যাপের সার্ভার পরিচালনা হতো সিলেটের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে।
ইউএস এগ্রিমেন্টের প্রতারণার ঘটনায় সম্প্রতি রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন মোস্তাক হোসেন (৪৫) নামের প্রতারিত হয়েছেন এমন এক ব্যক্তি। তার বাড়ি নগরীর বহরমপুর এলাকায়। অভিযোগের সঙ্গে তিনি প্রতারিত অন্যদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং তাদের বিনিয়োগের পরিমাণও উল্লেখ করেন। এ অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসে পুলিশ। গত বুধবার (১৭ জানুয়ারি) মোস্তাকের অভিযোগটি রাজপাড়া থানায় মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলায় পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
আসামিরা হলেন- ইউএস এগ্রিমেন্টের রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান মো. ওয়াহেদুজ্জামান সোহাগ (৩৮), বিভাগীয় ব্যবস্থাপক ফাতেমা তুজ জহুরা ওরফে মিলি (৩২), কান্ট্রি লিডার মোতালেব হোসেন ভূঁইয়া (৩৫), কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারুক হোসাইন সুজন (৩৯) এবং রাজশাহী জেলা এজেন্ট মিঠুন মণ্ডল (৩৬)। এদের মধ্যে ওয়াহেদুজ্জামান সোহাগ ও ফাতেমা তুজ জহুরা ওরফে মিলি স্বামী-স্ত্রী। তাদের বাড়ি রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া এলাকায়। কান্ট্রি লিডার মোতালেব লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ, কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারুক মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল এবং রাজশাহী জেলা এজেন্ট মিঠুন নগরীর বোয়ালিয়াপাড়া মহল্লার বাসিন্দা। মামলার বাদীর দাবি, তারা গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। এরাই চক্রের মূলহোতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলার বাদী মোস্তাক হোসেন হারিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রতারিত ৫৮ জনের একটি নামের তালিকা পাওয়া গেছে। এরমধ্যে নগরীর কুমারপাড়ার খালেদ ইমাম ১ লাখ, শালবাগানের জাকির ফেরদৌস ১২ লাখ, নামোভদ্রার আব্দুর রাকিব ৬ লাখ, লক্ষ্মীপুর টিবি রোডের রবিউল ইসলাম ৪ লাখ, গোলাম আকবর সরকার ৩০ লাখ, শিরোইলের আবু বক্কর সিদ্দিক ২৫ লাখ, বহরমপুরের কাইজার আহমেদ ২ লাখ, সারোয়ার হোসেন ১ লাখ, ছোটবনগ্রাম উত্তরপাড়ার সাইদুর রহমান ৫ লাখ, ছোটবনগ্রাম পূর্বপাড়ার লিটন হোসেন ৫ লাখ, মাসিদুল হাসান ৬ লাখ, জোত মহেশের রানা মাহফুজুল হক ১১ লাখ, রাণীনগরের মিলনুর রশীদ ১০ লাখ, বল্লভগঞ্জের জাহাঙ্গীর কবীর ১৫ লাখ, সেলিম রেজা ১২ লাখ, আলমগীর কবির ৩ লাখ, সাতবাড়িয়ার আল-আমিন ৩ লাখ ৯০ হাজার, চারঘাটের হাবিবপুরের রেজাউল করিম ৯০ লাখ, হড়গ্রামের মো. আনিসুজ্জামান ১০ লাখ, চন্দ্রিমা আবাসিকের জুবায়েদ সরকার ১১ লাখ, টিকাপাড়ার আনোয়ার হোসেন ৮ লাখ, সাগরপাড়ার রহিমা খাতুন ১৫ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
রাজশাহীর বাইরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের লাহাবপুরের আরিফুর রহমান ৪ লাখ, কিশোরগঞ্জের সগুড়ার মো. ফারুক সাড়ে ১৩ লাখ, টাঙ্গাইলের কালিহাতি বানিয়াবাড়ির রাজীব সাহা ৯ লাখ, সিরাজগঞ্জের ধুকুড়িয়ার অনন্ত কুমার সাহা ৮ লাখ, নাটোরের বড়াইগ্রামের রেবেকা সুলতানা ১ লাখ ও নওগাঁর হরিরামপুরের শারমিন সুলতানা ২০ লাখ খুইয়েছেন। রাজশাহীতে মামলা হওয়ার পর দেশের অন্যান্য স্থান থেকেও ভুক্তভোগীরা এ মামলার বাদী মোস্তাক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। করণীয় বিষয়ে জানতে চাইছেন। বাদীর দাবি, রাজশাহীতে প্রায় শতাধিক ব্যক্তির ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সারাদেশে গ্রাহক ছিলেন প্রায় দুই হাজার। হাতিয়ে নেয়া টাকার পরিমাণ হবে অন্তত ৩০০ কোটি।
মামলা দায়েরের পর টাকা আদায়ে করণীয় নির্ধারণ করতে রাজশাহীর প্রায় অর্ধশত ভুক্তভোগী শনিবার সকালে নগরীর একটি রেস্তোরাঁয় বসেছিলেন। ভুক্তভোগীদের একজন জানান, ইউএস এগ্রিমেন্টে তিনি ২০২০ সালে বিনিয়োগ করেন। প্রথমে বিনিয়োগ করেন ৫ লাখ টাকা। ছয়-সাত মাস এই টাকার লভ্যাংশ পান। তা দেখে আরও প্রায় ৫৫ লাখ টাকা তুলে দেন জেলা এজেন্ট মিঠুনের হাতে। কিন্তু পরের এই টাকার কোনো লভ্যাংশ পাননি। আসল টাকাও ফেরত পাননি।
ভুক্তভোগীরা জানান, সোহাগ ও মিঠুন নিজেই নগদ টাকা নিতেন। এরপর গ্রাহকের মোবাইলে একটি অ্যাপ ইনস্টল করে দিতেন। গ্রাহকের আস্থা অর্জনে তারা তাদের ব্যাংক হিসেবে বিদেশি সহযোগীদের মাধ্যমে ডলার পাঠিয়ে দিতেন। বলতেন, এটি বিনিয়োগের রেমিটেন্স এসেছে। এভাবে বিশ্বাস অর্জন করে তারা টাকা লুটে নিয়েছেন। সব গ্রাহককেই দুই-একমাস ব্যাংকের মাধ্যমে লভ্যাংশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লগ্নিকারীদের বলা হয়েছে, ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা হয়েছে। তাই রেমিটেন্স ঢুকছে না। কাউকে কাউকে নগদেও দু’একবার লভ্যাংশ দিয়েছেন প্রতারকেরা। তারপর যোগাযোগ বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছে তারা। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তদন্ত চলছে। জড়িতদের খুঁজে আইনের আতায় নেয়া হবে শিগগিরিই।
একুশে সংবাদ/চ.ট.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :