প্লাষ্টিকের জীবনচক্রের প্রথম ধাপ হচ্ছে জীবাশ্ম জালানি, অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশন। এই নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার ফলে বায়ু ও পানি দূষণ হচ্ছে এবং নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড় মারাত্নক ঘটনা ঘটছে। প্লাস্টিক বর্জ্যের ফলে দূষিত হচ্ছে মাটি এবং এর ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কারণে জীব ও উদ্ভিদের ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে কৃষি জমির উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার কারণে পরিবেশে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ মিশে বায়ু দূষণের ফলে শ্বাস—প্রশ্বাস জনিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অন্যদিকে পলিথিন ও প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হচ্ছে। মাইক্রো প্লাস্টিক মাটি ও পানিতে মিশে বিভিন্ন সবজি, ফল ও প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে। পরে এগুলো খাদ্য হিসেবে মানুষের শরীরের মধ্যেও প্রবেশ করছে। নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে যদি এখনই কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে কালীগঞ্জের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক পরিবেশ আইন কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী জানা যায়, প্রায় ৯৯ শতাংশ প্লাস্টিকই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। এর কাঁচামাল রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্লাস্টিক পলিমার তৈরি হয়। প্লাষ্টিকের বৈশিষ্ট বৃদ্ধির জন্য এর সহিত প্লাস্টিসাইজার, রঞ্জকদ্রব্যের মতো সংযোজনকারী কিছু পদার্থ মেশানো হয়।
যত্রতত্র ফেলে দেয়া পলিথিন পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করছে এবং কৃষিজমি ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। পলিথিন অপচনশীল প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ থাকায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপরিবর্তিত, অবিকৃত থেকে মাটি ও পানিকে দূষিত করে থাকে। এতে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে ফেলে। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যবসায়ীরা অবাধে এই নিষিদ্ধ পলিথিন কালীগঞ্জ বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন খোলা বাজারে সরবরাহ করছেন এবং দোকানিরা বিক্রি করছে। যা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি বলে মনে করেন স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধিরা।
কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুর বাসাইর বাজার, সাওরাইদ বাজার, আওড়াখালী বাজার, দালান বাজার, ফুলদী বাজার, নরুন বাজার, উলোখোলা বাজার, নাগরী বাজার ও কালীগঞ্জ বাজরের মাছ পট্রিতে দেখা যায় পলিথিনের অবাধ ব্যবহার। মুদি দোকান, কাপড়ের দোকান, ফলের দোকান, মাছ—মাংশের দোকান, কাঁচা তরিতরকারীর দোকান থেকে শুরু করে এমন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার নেই। পাঁচ টাকার জিনিস কিনলেই ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে সরবরাহের জন্য পলিথিন।
সর্বত্রই নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এ পণ্য নিয়ন্ত্রণে মাঝে মধ্যে অভিযান চালানো হলেও এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার এতটুকু কমেনি। নিজের দেশে উৎপাদিত পণ্যের বিকল্প নেই বলে বাজার সয়লাব হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিনে। বাজার, হোটেল ও রেস্তোরার পাশে লক্ষ করলে দেখা যায় প্রতিটি অলিগলি, ড্রেন, নালা, খাল ও পতিত জলাশয় প্লাস্টিক বোতল ও পলিথিনে বদ্ধ হয়ে আছে। আর সেই বদ্ধ জলাশয়ের দূষিত পানিতে জন্ম নিচ্ছে রোগবাহিত মশাসহ ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো নানা ধরনের জীবানু।
উপজেলার পৌরসভার কালীগঞ্জ বাজারের মসলা বিক্রেতা পনির হোসেন বলেন, পলিথিন পূর্ব হতেই চলে আসছে, তাই ক্রেতাদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে আমরা পলিথিনে মালামাল সরবরাহ করে থাকি। তবে পলিথিনের পরিবর্তে পরিবেশবান্ধব কোন কিছু থাকলে পলিথিন ব্যবহার করতাম না।
জামালপুর ইউনিয়নের বাসাইর বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল হোসেন জানান, পলিথিন তুনামূলক বেশ সস্তা, হাতের কাছে পাওয়া যায়। পলিথিন কম দামে পাওয়া যায় বলে ব্যবহার করছি। তা ছাড়া এর বিকল্প হিসেবে কম দামে আমাদের দেশে কিছু তৈরি হয়নি। সরকার ইচ্ছে করলে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের তেরি ব্যাগ বাজারজাত করলে পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে রক্ষা করা যেত।
কালীগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মূ. নাজমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে কালীগঞ্জের খোলা বাজারে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যা খুবই উদ্বেগজনক ও হতাশার। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও কাঠোর আইন থাকার পরও নিষিদ্ধ পলিথিন বিক্রি বন্ধ হচ্ছে । ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই এর জন্য দায়ী। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনকেও আন্তরিক হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
সরকার আইন করে পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে আনলেও বর্তমানে প্রশাসনের উদাসীনতায় কালীগঞ্জের সকল বাজরে ব্যাপকহারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আজিজুর রহমান জানান, পলিথিনের ব্যবহার রোধে প্রশাসনের ইচ্ছে করলেই ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে পলিথিন ব্যবহার কমাতে পারবেনা। তবে সরকারী ভাবে পলিথিনের বিপরীতে বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।
তিনি আরোও বলেন, পলিথিনের বিপরীতে দেশীয় পাটজাত পণ্য ব্যবহার করলে পলিথিনের ব্যবহার কমে আসবে। পলিথিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে সাধারণের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাত ও ব্যবহার শুরু করে। পরে ২০০২ সালের ১ মার্চ বাংলাদেশ সরকার পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়। বাজারজাত করলে রয়েছে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা।
পলিথিনের ভয়াবহ দিক ও করনীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া প্রতিবেদককে বলেন, ব্যবহৃত পলিথিন থেকে বর্জ্য আলাদা করে পূণরায় রিসাইকেল করতে পারলে পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব। পলিথিনের বিভিন্ন কারখানায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে সঠিক সময়ে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। সরকারের সবোর্চ্চ মহলের সংশ্লিষ্ট সকল কতৃর্পক্ষ যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে পলিথিন উৎপাদন রোধ করা সম্ভব।
একুশে সংবাদ/ক.ও.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :