মৌমাছি মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই। ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের এই মহান উক্তিটির মৌসুম চলছে শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী মৌ খামার গুলোতে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। মৌমাছির গুনগুন শব্দে মুখরিত হয় কালোজিরা, সরিষা, ধনিয়ার মাঠ। মৌমাছিরা এক ফুল থেকে আরেক ফুলে নাচানাচি করে। এ যেন কালোজিরা সরিষা ফুলের সাথে তাদের গভীর মিতালী। আবার দিনের আলো যাওয়ার আগেই তাদের জন্য মৌ চাষীদের গড়ে তোলা ঘরে ফিরে আসছে মৌমাছিরা।
শরীয়তপুর জেলার সদর, জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠজুড়ে অপরূপ সৌন্দর্য ছড়িয়ে রয়েছে। চারদিকে কালোজিরা ও ধনিয়া ফুলের সমারোহে। যেদিকে চোখ যায় মনে হয় যেন ফুলের চাদরে ঢেকে আছে ফসলের মাঠ। আর এসময়ে শরীয়তপুরের মধু চাষীরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কালোজিরা, সরিষা ও ধনিয়া ক্ষেত থেকে মধু সংগ্রহে। ফসলের জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌ চাষীরা। ওইসব বাক্সে হাজারো মৌমাছি মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফসলের মাঠে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এবার শরীয়তপুর জেলায় কালোজিরা ৩ হাজার ৫২০ হেক্টর, ধনিয়া ৬ হাজার ৫৬ হেক্টর এবং সরিষা ১ হাজার ৪৫০ হেক্টর মিলে মোট ২৪ হাজার ২৬ হেক্টর জমি আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে ১১ হাজার ৪০ হেক্টর জমি মৌ চাষের আওতায় রয়েছে। এতে মৌবাক্স স্থাপণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৫৮০টি। আর এ মৌসুমে গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মধু সংগ্রহ হয়েছে ২০ হাজার ১২০ কেজি। এরমধ্যে কালোজিরার মধু ৩ হাজার ৪৮০ কেজি, ধনিয়ার মধু ৯ হাজার ৪৫০ কেজি এবং সরিষা ফুলের মধু ৭ হাজার ১৯০ কেজি। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবার মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩০ হাজার ৬০০ কেজি।
সাধারণত অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে বেশি পরিমাণে মধু সংগ্রহ হয়। মৌ বাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহে মৌচাষী ও শস্যচাষী উভয়ই লাভবান হয়ে থাকেন। মধু চাষের মাধ্যমে মৌচাষীরা যেমন বাড়তি আয় করেন, তেমন মৌমাছির পরাগায়ণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
ইতোমধ্যে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন কর্তৃক কালোজিরার মধু জেলা ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
মৌচাষী শাহীদুল ইসলাম বলেন, "আমি পাঁচটি বক্স নিয়ে মৌচাষ শুরু করি। আল্লাহর রহমতে এখন দুইশতাধিক বক্সের মালিক আছি। আমরা সাধারণত পছন্দমত ক্ষেতের পাশে খোলা জায়গায় চাক ভরা বাক্স রাখি। একেকটি বাক্সে মোম দিয়ে তৈরি ৮ থেকে ১০টি মৌচাকের ফ্রেম রাখা হয়। আর এর ভেতর রাখা হয় একটি রাণী মৌমাছি। রাণী মৌমাছির কারণে ওই বাক্সে মৌমাছিরা আসতে থাকে। মৌমাছিরা ফুল থেকে মধু এনে বাক্সের ভেতরের চাকে জমা করে। আর এই চাক থেকেই আমরা মধু সংগ্রহ করি। বর্তমানে আমার শরীয়তপুর জেলার সদর, জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলায় খামার রয়েছে।
আরেক মৌ খামারী ওয়াহিদুর রহমান ওয়াহিদ বলেন, আমি জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ কালোজিরা ক্ষেতে ১৬৫ টি মৌ বাক্স বসিয়েছি। এসব বাক্স থেকে প্রতি বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে ৪-৫ টনের মতো মধু পাওয়া যায়। কালোজিরার প্রতি কেজি মধু ১৫০০-১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।
বিলাসপুর এলাকায় পাবনা থেকে আসা মৌচাষী শাহজাহান বলেন, কালোজিরা ও ধনিয়া ক্ষেতের পাশে মধু সংগ্রহের জন্য ২৫০ টি বাক্স বসানো হয়েছে। অন্য বছরের তুলানায় এই বছরে আবহাওয়া ভালো হওয়ায় মধু সংগ্রহ বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপপরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি বর্তমানে শরীয়তপুরে যে পরিমাণ মৌচাষ করা হচ্ছে তা আরো বৃদ্ধি পাক এবং সারাদেশ থেকে যেন মৌচাষীরা আমাদের এলাকায় এসে মৌচাষে উদ্বুদ্ধ হয় সে লক্ষে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পরিচিতদের আমাদের শরীয়তপুরে কালোজিরা, ধনিয়া ও সরিষার অধিক আবাদ সম্পর্কে জানান দিচ্ছি।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, জাজিরায় কালোজিরার মধু অধিক উৎপাদন হওয়ায় জেলা ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে। এখন এর চাহিদাও বাড়ছে। আরো বেশী উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।
একুশে সংবাদ/ক.জ.প্র/জাহা
আপনার মতামত লিখুন :