নড়াইলের লোহাগড়া এক আতঙ্কিত জনপদের নাম। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলায়। সেখানে তিন দিনের ব্যবধানে একজন সাবেক চেয়ারম্যানসহ তিনজন খুন হয়েছেন। খুনের ঘটনার পর স্থানীয় জনগণের মনে উদ্বেগ ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। চাঞ্চল্যকর এসব খুনের ঘটনার পর পুলিশের কোনো পদক্ষেপেই সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না। ভয়, আতঙ্ক আর চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা একটি পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত। গ্রাম্য কোন্দল আর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ উপজেলাজুড়ে চলছে হত্যাকাণ্ড, হামলা-মামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট।
এ উপজেলার এমন কোনো গ্রাম নেই-যেখানে কোন্দল নেই। জনপ্রতিনিধি আর মাতুব্বরদের আশ্রয়-প্রশয়ে গ্রাম্য কোন্দলের মীমাংসা হয় না, বরং এসব কোন্দল জিইয়ে থাকে। এসব কারণে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপেই থামে না এ অভিশপ্ত গ্রাম্য কোন্দল। এখন লোহাগড়া এক আতঙ্কিত জনপদের নাম। সেখানে হত্যা, সংঘাত ও নৈরাজ্যের মহোৎসব চলছে।
গ্রাম্য কোন্দলের জের ধরে একের পর এক খুনের ঘটনায় লোহাগড়া এখন স্তব্ধ। সন্ধ্যার পর প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না। অব্যাহত খুনের ঘটনার কারণে চলমান উপজেলা নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় ভাটা পড়েছে। ভয়,আতঙ্ক আর চরম নিরাপত্তাহীনতায় আসলেই কুঁকড়ে গেছে লোহাগড়া জনপদ।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গত (১০ মে) রাত সাড়ে ৭টার দিকে লোহাগড়া বাজার থেকে একটি শালিস বৈঠকে যোগদানের জন্য উপজেলা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ও মল্লিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শিকদার মোস্তফা কামাল (৫৩) নিজের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলে করে কুন্দশী এলাকার ছমীর শিকদারের বাড়ির সামনে যান। এরপর সড়কে মোটরসাইকেলটি রেখে বাড়ির ভেতরে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মোস্তফা মোটরসাইকেলটি আনার জন্য সেখানে গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ এ আওয়ামী লীগ নেতাকে ঢাকায় নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
উল্লেখ্য, নিহত শিকদার মোস্তফা কামাল লোহাগড়া উপজেলার মঙ্গলহাটা গ্রামের মৃত আকরাম শিকদারের ছেলে এবং মল্লিকপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।
চেয়ারম্যান শিকদার মোস্তফা কামাল খুনের ঘটনায় তার ভাই রিজাউল শিকদার বাদী হয়ে সাবেক ইউপি সদস্য আকবর হোসেন লিপনকে প্রধান আসামি করে লোহাগড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
চেয়ারম্যান খুনের ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব গত বৃহস্পতিবার (১৬ মে) লোহাগড়া, নড়াইল ও চট্টগ্রাম থেকে অভিযান চালিয়ে ভাড়াটিয়া কিলার সাজেদুল মল্লিকসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। এর আগে একজন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে লোহাগড়া থানার ইন্সপেক্টর মেহেদী হাসান জানিয়েছে।
জনপ্রিয় নেতা মোস্তফা খুনের ঘটনার এক দিন পর ১১ মে রাতে চর মঙ্গলহাটা গ্রামে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা রিজিয়া বেগম (৭০) নামের একজন বৃদ্ধ নারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এরপর তাকে জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রেখে পালিয়ে যায়। নিহত রিজিয়া বেগম চর মঙ্গলহাটা গ্রামের প্রয়াত শিক্ষক তবিবর রহমানের স্ত্রী এবং যুবলীগ নেতা রবিউল কবীরের মা। হত্যার পরের দিন ১২ মে যুবলীগ নেতা রবিউল কবীর বাদী হয়ে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের নামে থানায় মামলা দায়ের করলেও পুলিশ ঘটনার কোনো ‘ক্লু’ উদ্ধার করতে পারেনি।
চেয়ারম্যান ও বৃদ্ধা খুনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১২ মে রাত সাড়ে ৮টার দিকে লোহাগড়া পৌরসভার প্রাণকেন্দ্র ৭ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপাশার সিনিয়র সাংবাদিক রূপক মুখার্জির বাড়ির দক্ষিণ পাশের সড়কে আরেকটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এ সময় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা মো. ফয়সাল মুন্সী (২৫) নামের একজন ভ্যানচালককে ছুরিকাঘাতে খুন করে ভ্যান ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।
নিহত ফয়সাল লোহাগড়া উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া গ্রামের আহম্মদ মুন্সীর ছেলে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও খুনের ঘটনার কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা লোহাগড়া থানার এসআই অমিত বিশ্বাস জানান, তদন্তের কাজ শুরু হয়েছে এবং জড়িতদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাঞ্চন রায় জানান, চেয়ারম্যান, বৃদ্ধা এবং ভ্যানচালক খুনের ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চেয়ারম্যান খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে খুনের ঘটনায় জড়িত ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।
বৃদ্ধা রিজিয়া বেগম ও ভ্যানচালক ফয়সাল মুন্সীস্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং খুব সহসাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :