স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে গায়ে গতরে খেটে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছিল বাধের সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়া জাহেদুল ও তার স্ত্রী মেহেনা। যতই দিন গড়াচ্ছিল ততই সংসারে অভাব অনটন বাসা বাধছিল তাদের। গত ২ বছর আগে বাধের রাস্তা থেকে উচ্ছেদ হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাধের পাশেই বছরে ৩ হাজার টাকায় ৫ শতকের ভাড়া করা জমিতে। সেখানে একটি কাঁচা ঘর আর একটি রান্না ঘরেই সীমাবদ্ধ জীবন চলে তাদের।
হঠাৎই ভাগ্য অন্বেষনে উত্তর ছেড়ে দক্ষিণে পাড়ি জমায় জাহেদুল। এদিকে স্ত্রী মেহেনা তার দু সন্তান নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করে করে যা পায় তাই দিয়ে চলছিল তাদের জীবন। স্বামী জাহেদুল ঢাকা চলে যাওযার পর চোখে মুখে বিষন্নতাসহ এক দুরাশা নিয়ে সন্তানদের নিয়ে বাধের পাশেই ভাড়া করা জায়গাতেই থেকে যায়। বর্তমান তাদের ঠিকানা উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের ডোবার পাড়া গ্রামে।
ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকা দুই সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়ে মেহেনার জীবন। মা মেহেনা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় বিভিন্ন জায়গায় হাত পেতে বিয়ে দিয়েছে। এর কিছু দিন পরই ছেলেটিও বিয়ে করেছে। মেয়ে তার শশুর বাড়িতে, ছেলে বৌ নিয়ে ওই ৫ শতকের বাড়িতেই অবস্থান করছে। মেহেনা দিন গুনতে থাকে কবে আসবে তার শেষ ভরসার মানুষটি। দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকার আশেপাশে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে নিজ জীবিকা নির্বাহসহ পরিবারের চিন্তা করে জাহেদুল। গত রমজান মাসে ব্যস্ত শহর ঢাকায় সড়ক পাড়াপাড়ের সময় দ্রুত গতির একটি গাড়ি ধাক্কা দেয় তাকে। ওখানেই জাহিদুল অচেতন হয়ে পড়লে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে একটি হাসপাতালে নিলে সেখানেও দ্রুতই উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে পাঠায় তাকে। সেই হাসপাতালে কিচ্ছুক্ষণ চিকিৎসার পর মারা যায় জাহেদুল। এ খবর কোনো ভাবে তার স্ত্রী মেহেনার কাছে পৌছালে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে এবং স্বামীর লাশ কিভাবে বাড়িতে আনবে দিশেহারা হয়ে পড়ে মেহেনা। চোখে-মুখে দেখতে থাকে আরেক অন্ধকার।
স্বামীর লাশ পরিবহনে গ্রামের বিত্তবানদের দাঁড়ে দাঁড়ে ঘুরে যা পেয়েছিলো তা দিয়ে কোনো ভাবেই লাশ বাড়ি পর্যন্ত আনা সম্ভব হয়ে উঠবেনা জেনেও ভাগ্য বিড়ম্বনাকে মেনে নিয়ে মেহেনা লাশ পরিবহনে ধার করেছিলো প্রায় ২৬ হাজার টাকা। স্বামীর লাশ পরিবহনের ঋণের বোঝা দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে হয় তাকে। দীর্ঘ সময় পর মেহেনার এই করুন পরিনতির বিষয়টি `পাশে দাড়াই` সংগঠনের সোশ্যাল এক্টিভিস্ট মারুফ আহমেদের নজরে আসলে মেহেনাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোষ্ট দেন। এই পোস্ট মুহুর্তেই বিত্তবানদের চোখে পড়ে যায় এবং দ্রুতই মেহেনার ঋণ পরিশোধের টাকার ব্যবস্থাও হয়ে যায়।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) বিকেলে `পাশে দাঁড়াই` টিমের সদস্যবৃন্দ তার বাড়িতে গিয়ে দেখতে পায়, মেহেনার বাড়িতে কোমর পর্যন্ত পানি জমাট বেধে আছে। তিনি বাড়ির পাশেই সড়কের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। মেহেনার থাকার ও রান্না ঘরে পানি। ছোটো আকারের বাঁশের খুঁটির উপর হেটে হেটে তার তার ঘরে ঢুকতে হয়। বাড়িতে রান্না নেই, অন্যের বাড়িতে কাজ করে সেখানেই খেয়ে এসে ওই পানি বন্দি ঘরেই আশ্রয় নিতে হয় তাকে। `পাশে দাঁড়াই` সংগঠনের সদস্যবৃন্দ পানি পাড়ি দিয়েই তার হাতে স্বামীর লাশ পরিবহনের ঋণ পরিশোধের জন্য পুরো টাকাটাই তার হাতে তুলে দেয়। ঋন পরিশোধের টাকা হাতে পেয়ে এক অজানা দুঃখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মেহেনা এবং বার বারই বলতে থাকেন `বাবারা তোমরা মোক বাঁচাইলেন।` `পাশে দাঁড়াই` সংগঠনের সদস্যদের জন্যও দোয়া কামনা করেন তিনি।
` পাশে দাঁড়াই` সামাজিক সংগঠনটি দীর্ঘ সময় ধরে একটি চ্যারটি স্কুলসহ বিভিন্ন সময় অসহায় ও দুস্থ মানুষদের জন্য কাজ করে আসছে। `পাশে দাঁড়াই` সামাজিক সংগঠনের সোশ্যাল এক্টিভিস্ট ও তরুন উদ্যোক্তা মারুফ আহমেদ জানান, বিভিন্ন সময় দুর্গম চরাঞ্চলে ও দুস্থ মানুষদের নিয়ে আমাদের সংগঠনটি কাজ করে আসছে। তারই অংশ হিসেবে মেহেনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছি, আমাদের এ ধরনের কাজগুলো চলমান থাকবে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :