টানা ১ যুগ ধরে বেনাপোল কাস্টম হাউস রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জণে ব্যর্থ হলেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৬.৫৯ কোটি টাকা বেশি আয় করেছে।
সুত্রে জানা যায়, এ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেনাপোল কাস্টম হাউসকে বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৬২৩৮ কোটি টাকা। সেখানে বেনাপোল কাস্টম হাউস ৩০ জুন-২০২৪ পর্যন্ত সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করেছেন ৫৯৪৮ কোটি টাকা। আদায় দেখিয়েছেন ৬১৬৪.৫৯ কোটি টাকা। যা শতকরা প্রবৃদ্ধির হার প্রকাশ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি।
এই সময়ে এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি হয়েছে ১৭ লাখ ২১ হাজার ৭৮০ টন। যা বিগত বছরের তুলনায় ২ লাখ ৮১ হাজার ৯৭০ টন কম। এখানে পণ্য আমদানি কমলেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্যে যতো বাণিজ্য সম্পাদিত হয় তার প্রায় ৮০ ভাগ পণ্য আমদানি হয় বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে। তবে বৈশি^ক মন্দাসহ নানা কারণে গেল কয়েক বছর ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো এলসি করতে না পারায় আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া, ভারত থেকে আমদানিকৃত পণ্য শুল্কায়নে কাস্টম কর্মকর্তাদের লাগামহীন ঘুষ বাণিজ্য, কতিপয় চিহ্নিত দুস্কৃতিকারি আমদানিকারকদের মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্য পাঁচারে কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করা ও চেকপোস্ট কাস্টম দিয়ে সীমান্তের চোরাকারবারি সিন্ডিকেটের সাথে অবৈধ আতাতের মাধ্যমে অবাধে বিনা শুল্কে আমদানি পণ্য পাঁচার হওয়ায় দীর্ঘ ১ যুগ যাবত প্রতিবছর এ বন্দর থেকে কাস্টম কর্মকর্তা ও চোরাকারবারিরা আঙুল ফুলে কলাগাছ বনেগেলেও সরকার হারাতে থাকে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব।
জানা যায়, বিদায়ী অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে ফেব্রিক্স, পচনশীল কাঁচা পণ্য, ইংগড, ট্রাকের চেচিস, মটরপার্টস এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামাল থেকে। আর সর্বোচ্চ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল পাওয়ার গ্রীড কোম্পানি বিডি, এসএমসিএল নিলয় ও সএম কর্পোরেশন বলে জানিয়েছে কাস্টমস সূত্র।
স্থানীয় সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীরা জানান, বেনাপোল বন্দর থেকে সরকার প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করলেও বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষ জনক না। বন্দর থেকে পণ্য চুরি ও বারবার বন্দর অভ্যন্তরে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়া এ বন্দর দিয়ে বৈধ পথে আমদানি পণ্যের সাথে ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্য আসতে থাকায় ঝামেলা এড়াতে সচেতন ব্যবসায়ীদের অনেকে অন্য বন্দরে চলে গেছে।
নাম প্রকাশে ভয়ে ভীত বেনাপোল কাস্টমস ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডি এজেন্টের অধিকাংশ কর্মচারিরা জানান, বেনাপোল কাস্টমস হাউসের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা আমদানি-রপ্তানিকারকদের গলার ফাঁস। বেনাপোল বন্দর হয়ে ভারত-বাংলাদেশ আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি পণ্যের শুল্কায়ন করেন শুল্কায়ন কর্মকর্তারা। সেখানে পণ্যের শ্রেণিভেদে শুল্কায়ন করেন সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যুগ্ম কমিশনার পর্যন্ত। যেখানে ফাইল উপস্থাপনের সাথে পণ্য শুল্কায়নের আগেই নগদে প্রত্যেক দপ্তরের কর্মকর্তাদের পরিশোধ করতে হয় সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ টাকা।
কাস্টম সুত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বেনাপোল কাস্টমস হাউসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা, সেখানে আদায় হয়েছিলো ৫ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয় ১৮০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৬২৪৫ কোটি টাকা, আদায় হয়েছিলো ৪৫৯৯ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এতে রাজস্ব ঘাটতি হয় ১৬৪৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। তবে, সংশোধিত রাজস্ব আয় ৫১৫৮ কোটি টাকার বিপরীতে ঘাটতির পরিমান ৫৫৮ কোটি ৮ লাখ।
২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ হাজার ২৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, সেখানে আদায় হয়েছিল ৪ http://cricket.banglaconverter.org/হাজার ১৪৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। ওই বছর ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৯৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছিল ৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঘাটতি ১১৪৫ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঘাটতি ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
তবে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা রাজস্ব বেশি আদায় হয়েছিল, আবার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঘাটতি ২০৩ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ঘাটতি ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ তে ঘাটতি ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ তে ঘাটতি ৪৫২ কোটি ৮৯ লাখ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমান ছিল ১৯৪ কোটি টাকা।
তবে, এবারের (২০২৩-২৪) অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বেনাপোল বন্দরের কাস্টম সংশ্লিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। অধিকাংশরা বলেছেন, এবার দূর্ণীতি দমন কমিশন কর্তৃক বেনাপোল কাস্টম হাউসের অধিনে কর্মরত ঘুষখোর কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবসহ নগদ অর্থ ও সম্পত্তির খোজ-খবর নিলে বেরিয়ে আসবে অনেক অজানা তথ্য। বেরিয়ে আসবে নতুন চাকুরিতে প্রবেশকারিদের কর্মকর্তাদেরও অজ্ঞাত আয়ের পরিধি। তাতে, হয়রানী এড়িয়ে একদিকে এ বন্দর দিয়ে সুষ্ঠভাবে ব্যবসা বাড়াতে পারতে ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে সরকারের বাড়তে থাকবে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয়।
বেনাপোল কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার মির্জা রাফেজা সুলতানা বলেন, বেনাপোল কাস্টম হাউস কমিশনারের সঠিক দিকনির্দেশনায় এবার আমরা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছি। এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে জবাবদিহিতা ও কাজের প্রতি স্বচ্ছতা বেড়েছে। আগামীতে এ রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জণ অব্যাহত থাকবে।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :