বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাহবুব আলম ও তার অনুসারী প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলীর স্বেচ্ছাচারিতায় দূর্নীতি ও অনিয়মে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাধানগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। উপজেলা শিক্ষা অফিস, থানা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মেলেনি। অবশেষে এক শিক্ষকের দেওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমেছে দুদক। ঘটনাটি ঘটেছে পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী
উপজেলায়।
বিদ্যালয়ের জৈষ্ঠ্য শিক্ষক মোঃ মোস্তফা কামাল সবশেষ চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল দূর্নীতির ১৭টি বিষয় উল্লেখ করে বিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি মাহবুব আলম প্রধানের বে-আইনী কর্মকান্ডসহ প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলীর বিরুদ্ধে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড (মাউশি) ঢাকার মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- পিয়ন পদে নিয়োগের ধনেশ চন্দ্র দুলুর কাছ থেকে জন্য ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা আত্মসাত, জমিদাতা পরিবারের সদস্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সদস্যকে (বিজ্ঞ জেলা জজ) হুমকি প্রদান, সরকার প্রদত্ত্ব যাবতীয় টিউশন ফি আত্মসাত, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দাতা সদস্য হওয়ার জন্য টাকা নিয়ে তা বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসেব নম্বরে জমা না করে আত্মসাত, বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ শতাংশ জমিতে থাকা আম বাগান এবং পার্শ্ববর্তী পুকুর ও সুপারীর বাগান গোপনে ইজারা দিয়ে অর্থ আত্মসাত, বিদ্যালয়ের বেঞ্চ তৈরির কথা বলে গাছ কর্তন করে সেগুলো আত্মসাত করা হয়।
এর আগে দূর্নীতির অর্থ আত্মসাত বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষা অফিস ও ইউএনও অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দিলে ২০২৩ সালে ১১ জুন চাকরিবিধি অমান্য করে অসদাচরণের অভিযোগ এনে বিদ্যালয়ের জৈষ্ঠ্য শিক্ষক (মৌলভী) মোঃ মোস্তফা কামালকে চুড়ান্ত ভাবে বরখাস্ত করেন প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী।
দুদক বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য জেলা শিক্ষা অফিসকে নির্দেশ দিয়েছে। র্যাব দূর্নীতির বিষয়টি পৃথকভাবে তদন্ত করছে বলে দাবি করেছেন এই শিক্ষক। যদিও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দূর্নীতি, বিচারককে হুমকিসহ বিষয়ে আদালতে দেওয়ানী ও ফৌজদারী একাধিক মামলা চলমান।
বিদ্যালয় শুরুর দিকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক মাজেদা বেগমসহ স্থানীয়দের দাবি, রাধানগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরুতে পড়ালেখার মান ভালো থাকলেও অনিয়ম দূর্নীতির কারণে ক্রমেই নিচের দিকে যাচ্ছে পড়ালেখার মান। কোন্দলের কারণে কিছুদিন ম্যানেজিং কমিটির নিয়োগ বন্ধ থাকলেও পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন সভাপতি মাহবুব আলম প্রধান। জমিদাতা না হয়েও বনে গেছেন বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য। সুবিধা পেতে সঙ্গে নেন তৎকালীন আটোয়ারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তৌাহদুল ইসলামকে। একসময় স্থানীয় অভিভাবক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও অভিযোগের মুখে সভাপতির পদ ছাড়তে হলেও পরক্ষণই বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীন কোন্দলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে উপজেলা চেয়ারম্যানকে আহবায়ক করে গঠন করেন এডহক কমিটি।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদ্য সাবেক সভাপতি আবু সাঈদ জানান, নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন তারা। যে কারণে তৎকালীন সভাপতি মাহবুব আলম প্রধানের কর্মকান্ডে প্রতিবাদ করেননি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধান শিক্ষক সভাপতির কথামতো বিদ্যালয়ে কর্মচারি নিয়োগের জন্য একই পদে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে রেখেছেন। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুসকে সভাপতি বিদ্যালয়ের জমি লিজ দিয়ে যে টাকা নেন, তা বিদ্যালয় কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাত করেন।
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধের জন্য উচ্চ আদালতে মামলা চলমান অবস্থায় বে-আইনী ভাবে নতুন শিক্ষক নিয়োগের চেষ্টা করছে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি জানতে পেরে চলতি বছরের ৩০ মে শিক্ষকদের পক্ষে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমিক উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ণ কর্তৃপক্ষ(এনটিআরসিএ)’র চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করে জৈষ্ঠ্য শিক্ষক মোস্তফা কামাল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক ও ভূক্তভোগি ময়ুরের ভাই তোতা জানান, নিরপত্তা প্রহরী ও পরিচ্ছন্নকর্মী পদে চাকরির জন্য ময়ুর এর কাছ থেকে প্রায় ১১ লাখ টাকা নেন প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী। পাওনা টাকা ফেরত চেয়ে ৯ জুলাই দিনভর শিক্ষক মুকুল চন্দ্র ও প্রধান শিক্ষকসহ কয়েকজনকে অবরুদ্ধ করে রাখে স্থানীয়রা। এক পর্যায়ে রাতে ইউএনও, থানার ওসি ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের মধ্যস্থায় সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মিলে নগদ ৫ লাখ টাকা, ব্যাংকের দুইটি চেক, ৬শ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত গত ২০ জুলাইয়ের মধ্যে পরিশোধ করবে এবং অতিরিক্ত একলাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধোন্তে আপোষ-মীমাংসার হয়। যা সংবাদ আকারে স্থানীয় একাধিক পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তীতে স্থানীয়দের চাপসহ মামলা ঝামেলা এড়াতে নিয়োগের জন্য নেওয়া সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দেওয়া হয় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে।
প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী জানান, তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যা। অভিযোগকারী ধনেশ চন্দ্র দুলু চুক্তিভিত্তিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন চাকরি করে ২০১১ সালে পাওনা বুঝে নিয়ে ইস্তফা দিয়ে চলে যান। বিদ্যালয়ের সভাপতি মাহবুব আলম প্রধান তার কাছ থেকে কিছু লোন নিয়েছিল। পরবর্তীতে ধনেশ চন্দ্র দুলুর ছেলে সুজন রায়কে পিয়ন পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, বিদ্যালয়ে পাঠদান ভালোভাবে করলেও সময়মতো বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতেন না এবং বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক নিয়মনীতি মানতেন না জৈষ্ঠ্য শিক্ষক মোস্তফা কামাল।
বিদ্যালয়ে পড়াশুনার মান প্রসঙ্গে বলেন, বিদ্যালয়ের জমিদাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের পারিবারিক দ্বন্দ্বই পাঠার বলি ‘রাধানগর বালিকা
উচ্চ বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়ের জমি লিজ ও নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোকের থেকে নেওয়া টাকা ফেরত বিষয়ে সভাপতি মাহবুবব আলম প্রধান, ইউএনও, থানার ওসি ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের মধ্যস্থায় নিস্পত্তি করা হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি মাহবুব আলম প্রধান এর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি।
তবে প্রধান শিক্ষক দাবি করেন, সভাপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
মাউশি ঢাকার তদন্ত কর্মকর্তা ও অফিসার ইনচার্জ (কমার্শিয়াল সেল), অতিরিক্ত দায়িত্ব আইন শাখার কর্মকর্তা মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জানান, রাধানগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক আয়ুব আলী অফিসিয়াল ভাবে কোনরকম সাহায্য সহযোগিতা করছেন না, বরং তদন্ত কাজে অসহযোগিতা করছেন। যা আইন ও বিধি সম্মত নয়। ঘটনাস্থল ঘুরে প্রাথমিক ভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং প্রধান শিক্ষকের দূর্নীতি রয়েছে বলে মনে হয়েছে। প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সবকিছু বেড়িয়ে আসবে।
একুশে সংবাদ/সা.আ
আপনার মতামত লিখুন :