বংশী নদীর পানকাত্তা অংশ। নদীতে স্রোত নেই। পানির গতিও স্বল্প। তবুও পার ভাঙছে। শামসুল ইসলাম নামে এক কৃষক এই নদীতে হারিয়েছেন তার ২০ শতাংশ চাষের জমি। কিন্তু কেন শান্ত এই নদীতে পার ভাঙন? সরেজমিনে কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, নদীতে বসেছে তিনটি ড্রেজার। বছর জুড়ে এখানে নির্জন এলাকায় অবৈধভাবে চলে খনন। আর এর প্রভাবে নিয়মিত ভাঙছে নদীর পার।
শুধু পানকাত্তা নয়, ঢাকার ধামরাইয়ের বিভিন্ন ইউনিয়নে বংশী নদীর একাধিক পয়েন্টে এভাবেই লোকচক্ষুর অন্তরালে ড্রেজার দিয়ে চলে নদী খনন। অবৈধ এই খননে ক্ষতিগ্রস্ত নদীর আশপাশের জমির মালিকরা।
তথ্য বলছে, রাজনৈতিক যোগসাজশে ও গোপনে এসব ড্রেজার পরিচালনা করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারির অভাব ও শাস্তির অভাবে এই অবৈধ ব্যবসা ঠেকানো যাচ্ছে না।
যদিও প্রশাসন বলছে, নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ধামরাই জুড়ে বাড়ি নির্মাণ, নিচু জমি ভরাটসহ নানা কারণে বালু ভরাটের চাহিদা রয়েছে। আর এই চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা হয় নদী খনন করে অবৈধভাবে তোলা বালু মাটি থেকে। কোথাও কোথাও ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে স্তূপ করে রাখা হয়। সেখান থেকে ট্রাকে বিক্রি করা হয় বালু।
অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা জুড়ে পরিচালিত ড্রেজারগুলোর পরিচালনার সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জড়িত রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীরা।
স্থানীয় পর্যায়ে গত প্রায় ছয় মাসে কতগুলো ড্রেজার পরিচালনা করা হয়েছে এমন তথ্যের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চৌহাট ইউনিয়নের পাড়াগ্রাম মোড়ে একটি, ভাকুলিয়ায় একটি, চৌহাট ব্রিজের নিচে একটি, বালিয়া হাইস্কুলের পেছনে তিনটি, যাদবপুর ইউনিয়নের টেটাইল এলাকায় দুইটি, বাস্তা ব্রিজের নিচে দুইটি, আমছিমুর এলাকায় দুইটি, নরসিংহপুর কুশুরা ব্রিজের পাশে একটি, পানকাত্তায় তিনটি, কুশুরা নবযুগ কলেজের পাশে একটি, যাদবপুর ইউনিয়নের আমরাইল এলাকায় অন্তত দুইটি ড্রেজার পরিচালনা করা হয়েছে। তবে বন্যার মৌসুম চলে আসায় বেশিরভাগ ড্রেজারই বর্তমানে বন্ধ।
যদিও চৌহাট ইউনিয়নের পাড়াগ্রাম মোড়ে একটি, ভাকুলিয়ায় ও কুশুরা ইউনিয়নের পানকাত্তায় তিনটি ড্রেজার এখনও চলমান বলে জানা যায়।
সরেজমিনে ৯ জুন বিকেলের দিকে পানকাত্তায় গিয়ে দেখা যায়, আশপাশের কয়েকটি জমির মাটির বিলীন হয়েছে নদীতে। নদীর পাশে একটি বহুতল ভবনও রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সামসুল হক বলেন, ‘আমার ২০ শতাংশ জমি এরমধ্যে নদীতে চলে গেছে। আশপাশের আরও জমি ভাঙছে। হাবিব মেম্বার ড্রেজার চালাচ্ছে। আগেও অন্য একজন চালাত। অভিযোগ দেওয়ার পর সেটি বন্ধ হয়। এখন আবার মেম্বার চালাচ্ছে। এতে আমার কলা ক্ষেত, লেবু ক্ষেত ভেঙেছে। মেম্বারকে বলেছি, তবে সে সরায়নি।’পানকাত্তায় ড্রেজারটি পরিচালনা করছেন কুশুরা ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য হাবিবুর রহমান। তার দাবি, মসজিদের মাটি ভরাটের জন্য এই ড্রেজার পরিচালনা করছেন তিনি। কিন্তু মসজিদের জন্য নদীর মাটি খননের অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি এটি প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই চালাচ্ছেন বলে স্বীকার করেন। হাবিবুর বলেন, ‘মসজিদ ও একটি বাজারে বরাদ্দ এসেছিল। সেজন্যই এভাবে বালু তোলা হয়েছে।
প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে কাটা হচ্ছে কিনা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ইউএনও বালু উত্তোলন নিষেধ করে দিয়েছেন। আমাদের বিকল্প নেই দেখে এভাবে নদী থেকে তোলা হয়েছে। তবে এটির অনুমতি নেই। এতে কারো ক্ষতি হলে সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কুশুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘পানকাত্তায় ড্রেজার একবার জব্দ করা হয়েছিল। আমরা দেখবো বিষয়টি। আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই এই ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষার চেষ্টা করছি।’
এদিকে এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর গত ১৫ জুলাই পানকাত্তা এলাকায় গিয়ে ড্রেজারগুলো সরিয়ে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
চৌহাট ইউনিয়ন পরিষদের ভাকুলিয়া এলাকায় একটি ড্রেজার পরিচালনা করতে দেখা যায়। তবে সেখানে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, নদী থেকে বালু তুলে আশপাশের এলাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
চৌহাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পারভীন হাসান প্রীতি বলেন, ‘ড্রেজার পরিচালনা করার খবর পেলে গ্রাম পুলিশ পাঠিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভাকুলিয়ার ড্রেজারও বন্ধ করতে বলা হয়েছে। ড্রেজারে৷ ক্ষতি হয় বলে আমরা এটি পরিচালনা করতে দেই না।’
গেল ছয় মাসে ঠিক কতগুলো ড্রেজারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে ও কি ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য জেলা প্রশাসনে যোগাযোগের পরামর্শ ও লিখিতভাবে তথ্য চাওয়ার পরামর্শ দেয় তারা।
ধামরাইয়ে গত কয়েক বছরে অবৈধভাবে পরিচালিত ড্রেজার বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের পরিচালিত কয়েকটি অভিযানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব অভিযানে ড্রেজার জব্দ ও কোথাও কোথাও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর অভিযানে কাউকে খুঁজে না পাওয়ায় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের আমরাইল এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুটি ড্রেজার ও ড্রেজারে ব্যবহৃত পাইপ জব্দ করেছে ধামরাই উপজেলা প্রশাসন। তবে ড্রেজারের সঙ্গে জড়িত কাউকে জরিমানা কিংবা আটক করতে পারেনি প্রশাসন।
তার আগে ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি বালিয়া ওদুদুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের জন্য বসানো দুটি ড্রেজার মেশিন পুড়িয়ে দেয় উপজেলা প্রশাসন। ওই ঘটনায়ও জড়িত কাউকে জরিমানা কিংবা আটক করতে পারেনি প্রশাসন।
ধামরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) খান মো. আব্দুল্লা আল মামুন বলেন, ‘ড্রেজারের বিষয়ে আমরা কঠোর। এই বিষয়ে কোনো তথ্য কিংবা অভিযোগ পাওয়া গেলে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
ঢাকা জেলা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও জেলা নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য সচিব মো. শিবলী সাদিক বলেন, ‘এখানে কোনো বালু মহাল নেই। ফলে ড্রেজিং করার কোনো সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে জানানো হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘এভাবে ড্রেজিং করা হলে নদীর পার ভেঙে পড়বে। ভূমি ক্ষয় হবে। যার প্রভাব সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ওপর পড়ে। পরিবেশ রক্ষায় তাই প্রশাসন আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ. ন. ম. ফখরুদ্দিন বলেন, ‘কোনটা ড্রেজিংয়ের উপযোগী, কোনটি অনুপযোগী সেটি পরীক্ষা না করে বালু উত্তোলন করা হলে সেটি নদীর জন্য ক্ষতিকর। আর সেই ক্ষতির শিকার অনেকেই হতে পারেন। ইদানীং বালু বিক্রি ও ইট ভাটায় নেওয়ার জন্য যে ড্রেজিং করা হচ্ছে সেটি নেতিবাচক। এজন্য বিআইডব্লিউটিএসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবশ্যই তৎপর হতে হবে।’
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :