বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ ও লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘিরে সোমবার (৫ আগস্ট) সরকারের পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সরকারি স্থাপনা ঘর-বাড়ি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের যাতে কোন রকম আঘাত না আসে সে জন্য অনেক হিন্দু এলাকায় মন্দির, উপাসনালয় ঘিরে রাতের বেলায় সাধারণ মানুষ পাহারা বসিয়েছে। এতে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও যোগ দিয়েছেন। তাঁর পরেও রাতে কিছু কিছু এলাকায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছেই।
শেখ হাসিনা ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় গত পাঁচ দিনে এসব বাঁধাবিহীন হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ভাঙচুর করা হয় ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ও বিএনপির কার্যালয়। পরে অগ্নিসংযোগও করা হয়। এতে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এসব ঘটনায় বিএনপির নেতারা ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাদের দাবি বিএনপির কোন নেতাকর্মী এইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না। বরং তাঁরা রাত-দিন পাহারা দিচ্ছে যাতে কেউ সহিংসতা করতে না পারে।
এরমধ্যে সদরের সালন্দর, দেবীপুর, আকচা, নিমবাড়ি, বেগুনবাড়ি, রহিমানপুর, রাজাগাঁও, পাটিয়াডাঙ্গী, বালিয়াডাঙ্গী, রানীশংকৈল, পীরগঞ্জ ও হরিপুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বাড়িঘরে হামলার অভিযোগ উঠেছে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে।
তবে বিরূপ পরিস্থিতিতে সংবাদকর্মীরাও নিরাপদ বোধ করছেন না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘটনাস্থল পরিদর্শন করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে হামলা- ভাঙচুর -অগ্নিসংযোগের সঠিক ও সব তথ্য সংগ্রহ করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
ভাঙচুর করা হয়েছে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক কার্যালয়, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয় জেলা জজ কোর্ট চত্বর, চিফ জুডিশিয়াল ও অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এজলাসসহ প্রায় শতাধিক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছেন দুর্বৃত্তরা। এই অবস্থায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যার হলেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে পুরো শহর।
জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের হামলা, সহিংসতার চিত্র তুলে ধরা হল। ঠাকুরগাও সদর উপজেলার আখানগরের কেরানী পাড়ায় একটি বাড়িতে আগুনে পুড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরবর্তিতে লোকজন ছুটে এসে নেভানোর চেষ্টা করলেও সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সদরের বেগুনবাড়ি ইউনিয়নে একটি বাজারের দোকানপাটে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। জগন্নাথপুর ইউনিয়নেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়, ওই ইউনিয়নের গৌরীপুর, জুম্মাপাড়াসহ কয়েকটি স্থানে ঘটানো হয় এমন অরাজকতা।
সদরের সুখানপুকুরি ইউনিয়নের বাংরোট বাবুপাড়ায়, আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। যা জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সদরের আকচা ইউনিয়নের ফাড়াবাড়ি বাজারের বেশকিছু দোকানপাট ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। লুট করে নিয়ে যায় মালামাল। বাজারের পাশেই ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে সব লুট করে নিয়ে যায় দূর্বত্তরা।
দেবিগঞ্জ বাজারে এক সাংবাদিকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে মালামাল লুট করে নিয়ে যায় দূর্বত্তরা। শুধু তাই নয়, আকচা নিমবাড়ি এলাকায় বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। এতে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে ভুক্তভোগীরা। এখন আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয়দের।
দুর্বৃত্তদের হামলা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে আল মামুন (৩৫) ও শাহান (১৪) নামে দুই জন নিহত হয়েছেন। সদরের রুহিয়া কালিতলা এলাকার সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী হবিবর রহমানের ব্যবসা কেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে ওই ব্যবসায়ীর প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। তথ্যচিত্র ধারণের দুর্বৃত্তদের হামলায় তিনজন সাংবাদিককে আহত হন। এছাড়াও অন্যদিকে আরও দুই সাংবাদিকের বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ভিডিও ধারণ করতে গেলে দুর্বৃত্তরা বাংলাভিশন টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি খোদা বকশ ডাবলু , এসএটিভির জেলা প্রতিনিধি জাকির মোস্তাফি মিলু ও জি টিভির জেলা প্রতিনিধির এমদাদুল হক ভুট্টুর ওপরে হামলা ও মারপিট করে তাদের আহত করে। এছাড়াও তাদের দুইটি মোটরসাইকেল এবং মোবাইল ফোন ভাঙচুর করে। আহত হন প্রথম আলোর ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি মজিবর রহমান খানও। এছাড়া মাছরাঙা টেলিভিশনের ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধি বদরুল ইসলাম বিপ্লব ও লোকায়ন পত্রিকার রুহিয়া প্রতিনিধি দুলাল হকের বাড়িতে হামলা ও লুটতরাজ চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
অন্যদিকে, বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয় সদরের রাজাগাঁও ইউনিয়নে। সেখানেও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারুল ইসলাম সরকারের বেশকিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া হয়। লুটপাট করে নিয়ে যায় মালামাল। পুড়িয়ে দেয়া হয় কিছু যানবাহন।
সদরের আউলিয়াপুর ইউনিয়নের বিএডিসি’র এক সারের ডিলার নঈমউদ্দীন এন্ড সন্স মুজাহারুল ইসলামের গুদামে আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা। সার কীটনাষক পুরে ছাই হয়ে যায। এতে প্রায় দেড় কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়।
দুর্বৃত্তদের হামলায় শুধু অবকাঠামো বা মালামাল ক্ষতি হয়েছে এমনটি নয়। সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়নে প্রকাশ্যে আশরাফুল নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে লক্ষীপুর ডেবাডাঙ্গীর আলামিনের বিরুদ্ধে। সে ওই ইউনিয়নের বিএনপি নেতা। শুধু তাই নয়। এ ঘটনার পরেও সে ক্ষান্ত হয়নি। ওই ইউনিয়নের খসুপাড়া গ্রামের বেশকয়েটি বাড়িতেও হামলা চালায় ভাঙচুর করে অবকাঠামো। লুট করে নিয়ে যায়।
এছাড়া ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় শহরের শাহপাড়া, মন্দিরপাড়া, আটগ্যালারি, বিসিক মোড়সহ বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়ি ঘরে। লুট করে নিয়ে যায় মালামাল, দেয়া হয় আগুন। এমন ঘটনা থেকে রক্ষা পায়নি অন্যান্য উপজেলার বাসিন্দারাও। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিনমারী জুগিহার গ্রামের এই বাড়িটিতেও হামলা চালানো হয়। সব লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার উত্তম প্রসাদ পাঠক জানান, এসব সংঘটিত ঘটনার তালিকা করা হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে ধংসযোজ্ঞের সাথে কারা জড়িত। তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তথ্য প্রমাণ পেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :