রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় বৈষ্ণব ধর্মের মহাপুরুষ ঠাকুর নরোত্তম দাসের তিরোভাব তিথি উৎসব শুরু হয়েছে। সোমবার ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় শুভ অধিবাসের মধ্য দিয়ে এই উৎসব শুরু হয়। এটি ৪৯০তম মহোৎসব। প্রতিবছর লক্ষ্মী পূর্ণিমার পাঁচদিন পর পঞ্চমী তিথিতে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারো গোদাগাড়ী উপজেলার খেতুর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী গৌরাঙ্গবাড়ি মন্দিরে (খেতুরীধামে) নেমেছে ভক্তদের ঢল। দুই দিন আগে হতেই দেশের দূর দূরান্ত হতে ভক্তরা এসে আপন আপন থাকর জায়গা করে নিয়েছে। গোরাঙ্গবাড়ীর নির্ধারিত জায়গায় ছাড়াও রাস্তার দুইপাশে বিভিন্ন পসরার দোকান সাজিয়ে জমে উঠেছে খেতুরীধামে মহোৎসব।
সারা দুনিয়ায় বৈষব ধর্মের অনুসারীদের পাঁচটি ধাম রয়েছে। এরমধ্যে চারটিই ভারতবর্ষে। বাংলাদেশের একমাত্র ধাম এই খেতুরে। তাই বাংলাদেশের সনাতন বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক। দেশের আর কোথাও বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীদের এত বড় জমায়েত হয় না।
সোমবার সন্ধ্যায় শুভ অধিবাসের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার অরুনোদয় থেকে অষ্টপ্রহরব্যাপী চলবে নাম সংকীর্ত্তন। বুধবার ভোগ মহোৎসব, দধিমঙ্গল ও মহান্ত বিদায়ের মধ্য দিয়ে শেষ হবে অনুষ্ঠান।
স্থানীয় বাসিন্দা সমাজসেবক এহসানুল কবির টুকু জানান, উৎসব চলাকালে প্রেমতলী থেকে বসন্তপুর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধু ভক্তদের ভিড় থাকে। ওই তিন দিন মাইকে ২৪ ঘণ্টা কীর্ত্তন চলে। আশপাশে সব মুসলমানদের বাড়ি, কিন্তু কখনও কোনো সমস্যা হয় না। বরং মুসলমানরাও এ অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। বাড়ির উঠানে ভক্তদের থাকতে দেন। নির্দ্বিধায় বাড়ির শৌচাগার ব্যবহার করতে দেন। খেতুরীধামের আশপাশে মেলা বসবে বলে মানুষ একটু আগাম ধান চাষ শুরু করে। ধান কেটে নিয়ে জমি ফাঁকা রাখে।
গৌরাঙ্গদেব ট্রাস্ট বোর্ড পরিচালনা কমিটির সম্পাদক শ্যামাপদ সান্যাল বলেন, ‘খেতুরীধামের উৎসব নিয়ে এ এলাকার মানুষ যথেষ্ট আন্তরিক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কখনও এখানে বিশৃঙ্খলা হয়নি। শুধু প্রশাসন দিয়ে সবকিছু হয় না। স্থানীয়রাও সহযোগিতা করেন। ভক্তদের থাকার জন্য অনেকে নিজের ঘর ছেড়ে দেন। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে! এখানে যে মেলা বসে সেটা শুধু সনাতন বা বৈষ্ণব ধর্মের মানুষের নয়, সব ধর্মের মানুষই আসে।’
গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াত বলেন, ‘উৎসব ঘিরে প্রতিবছর বসন্তপুর থেকে প্রেমতলী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়কে আলোর ব্যবস্থা করা হয়। সেনাবাহিনী,পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক আছে। এবার পুলিশের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক হাজার জন করা হয়েছে। এ উৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। এখানে নরোত্তম ভক্তরা এসে মুসলিমদের বাড়িতে থাকে পর্যন্ত। এবারও এই সম্প্রীতি বজায় থাকবে।’
নরোত্তম ঠাকুর মহাশয় এর সংক্ষিপ্ত জীবনী থেকে জানা যায়, ১৫৩১ খ্রীষ্টাব্দে ঠাকুর নরোত্তম দাস তৎকালীন গড়েরহাট পরগণার অন্তর্গত ও বর্তমান গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মাতীরস্থ গোপালপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা জমিদার কৃষ্ণনন্দ দাস, মা নারায়নী রাণী। গোপালপুরে শৈশব অতিবাহিত করে ঠাকুর নরোত্তম দাস বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে নিখিল বৈষ্ণবকুল চূড়ামণি লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে দীক্ষা লাভ করেন।
পরে তিনি গোদাগাড়ীর খেতুরী গ্রামে আসেন। খেতুর মন্দিরে স্থাপনা গড়ে তোলেন এবং সেখানে উৎসব আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। এখানে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে তার কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেন।
১৬১১ খ্রীষ্টাব্দের কার্তিকী কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ঠাকুর নরোত্তম দাস নিত্তলীলায় প্রবেশের মানসে গঙ্গাস্নানের বাসনা প্রকাশ করেন। শিষ্যগণ তাকে গঙ্গাজলে নিয়ে গেলে নিজের দেহকে অর্ধনিমজ্জিত করে প্রিয় শিষ্য গঙ্গানারায়ণ ও রামকৃষ্ণকে আদেশ করেন দেহ মার্জন করতে। গুরু আজ্ঞায় নরোত্তমের ওই দুই শিষ্য দেহ মার্জন করতে থাকলে পুরো দেহ সাদা দুধের মতো তরল পদার্থে পরিণত হয়ে গঙ্গাজলে মিলিত হয়ে যায়। সে অনুযায়ী ঠাকুর নরোত্তম দাস পৃথিবীতে ৮০ বছর স্থায়ী ছিলেন।
এরপর থেকেই যুগ পরস্পরায় দুর্গাপূজার পর বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারীরা অহিংসার এই মহান সাধক ঠাকুর নরোত্তম দাসের কৃপা লাভের আশায় খেতুরী ধামে বার্ষিক মিলিত হয়ে থাকেন।
একুশে সংবাদ/এনএস
আপনার মতামত লিখুন :