নরসিংদীর কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যবাহী অমৃত সাগর কলা। এক সময় নরসিংদীতে প্রচুর দেশী জাতের অমৃত সাগর কলা হতো। কিন্তু দিনদিন লোকসানের ফলে এ জাতের কলা চাষ থেকে ফিরে আসছেন কৃষকরা। তার বদলে বাড়ছে বারি-১ জাতের কলাসহ অন্যান্য জাতের কলার চাষ।
কলা এক প্রকারের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ফল। সাধারণত উষ্ণ জলবায়ুসম্পন্ন দেশসমূহে কলা ভাল জন্মায়। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কলার উৎপত্তিস্থল হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে কলা অন্যতম প্রধান ফল।
বাংলাদেশের নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, যশোর, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, প্রভৃতি এলাকায় শত-শত বছর যাবত ব্যাপকভাবে কলার চাষ হয়ে আসছে। বিশেষ করে নরসিংদীতে প্রথম অমৃত সাগর কলার চাষাবাদ শুর হয়। বাংলাদেশে কলা চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল সারাবছর এ দেশের প্রায় সব অঞ্চলের উঁচু জমিতেই এর চাষ করা যায়। পার্বত্য এলাকায় বনকলা, বাংলাকলা, মামা কলাসহ বিভিন্ন ধরণের বুনোজাতের কলা চাষ হয়।
ল্যাটিন আমেরিকান দেশে কলা প্রধান অর্থকরী ফসল। প্রাগাধুনিক ভারতীয় অর্থনীতিতেও একটি প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে কলার চাষাবাদ হতো।
জানা যায়, এক সময় নরসিংদীতে প্রায় চার হাজার হেক্টর জমিতে দেশি জাতের কলা চাষ হতো। নরসিংদীর উৎপাদিত কলা চলে যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি জমির সংকোচন, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, কৃষি উপকরণের দামবৃদ্ধি, অন্যদিকে ক্রমাগত রাসায়নিক সার প্রয়োগে জমির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়া। সবকিছু মিলেই নরসিংদীতে অমৃত সাগর কলাসহ অন্য দেশি জাতের কলা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক।
কলা বিভিন্ন গুণাগুণে সমৃদ্ধ একটি ফল। এর পুষ্টিগুণ অধিক। এতে রয়েছে দৃঢ টিস্যু গঠনকারী উপদান যথা আমিষ, ভিটামিন এবং খনিজ। কলা ক্যালরির একটি ভাল উৎস। এতে কঠিন খাদ্য উপাদান এবং সেই সাথে পানি জাতীয় উপাদান সমন্বয় যে কোন তাজা ফলের তুলনায় বেশি। একটি বড় মাপের কলা খেলে ১০০ ক্যালরির বেশি শক্তি পাওয়া যায়। কলাতে রয়েছে সহজে হজমযোগ্য শর্করা। এই শর্করা পরিপাকতন্ত্রকে সহজে হজম করতে সাহায্য করে। কলার মধ্যে থাকা আয়রণ রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে।
গবেষকরা জানান, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ নিশ্চিত করতে দেহে পটাশিয়ামের উপস্থিতি অত্যন্ত জররি। এছাড়াও দেহে পটাসিয়ামের আদর্শ উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে কমে যায় স্ট্রোকের ঝুঁকিও। আর এই উপকারী পটাশিয়াম কলায় আছে প্রচুর পরিমাণে।
গবেষকরা দেখেছেন, একটি কলায় প্রায় ৫০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম থাকে। আর মানবদেহে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিগ্রাম পটাশিয়ামের যোগান দেয়া গেলেই স্ট্রোকের হাত থেকে বছরে বেঁচে যেতে পারে ১০ লক্ষ মানুষ।
চাষিরা জানান, কলা চাষের জন্য বেলে দোআঁশ মাটির প্রয়োজন হলেও তা এখন আর নেই। অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটি শক্ত হয়ে যাওয়ায় দেশি জাতের সাগর কলা চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। দেশি সাগর কলা রোপণ করলে গাছ বড় হয় না। আবার গাছ হলেও কলার ছড়িতেও কাঁদি বেশি জন্মে না। কলার আকারও অনেক ছোট হয়। মাটির কারণে কলার ছড়িতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেয়। এ কারণে অনেক চাষি দেশি সাগর কলা চাষাবাদ বন্ধ করে চম্পা, সবরি ও অন্যান্য জাতের কলার চাষাবাদ শুর করেছেন।
জানা গেছে, ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকেও নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় প্রায় ৪ হাজার হেক্টর জমিতে কলা চাষাবাদ হতো। তার মধ্যে অন্তত ৩ হাজার হেক্টরে চাষাবাদ হতো সবরি, কবরি, চাপা, চিনি চম্পা, অগ্নি সাগর ইত্যাদি। তৎকালীন সময়ে এই পরিমাণ জমিতে ৮০ টন কলা উৎপাদন হতো। ওই সময় কলা আবাদ ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এক থেকে দেড় লাখ মানুষ।
নরসিংদী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. লতাফত হোসেন জানান, জেলায় প্রায় ১২শ হেক্টর জমিতে পূর্বে অমৃত সাগর কলার চাষাবাদ হতো। বর্তমানে জেলা জুড়ে ৩শ হেক্টর জমিতে নেমে এসেছে কলার চাষাবাদ। সবমিলয়ে দেশি জাতের সাগর কলার চাষ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। বর্তমানে আবাদকৃত কলার বেশির ভাগই বারি-১ জাতের। এরপর রয়েছে চাপা, অমৃত সাগর ও সবরি কলা। মাটির গুণগত মান নষ্ট হওয়া ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে কৃষকরা ঝুঁকি নিয়ে দেশি জাতের কলা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এছাড়াও সাগর কলায় পানামা রোগের উপদ্রবে কমেছে চাষাবাদ।
তিনি আরো বলেন, পানামা রোগটি মূলত যেই পরিমাণে জমিতে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন এর চেয়ে কমবেশি হলেই হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, জেলার মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়িদে ৩ বিঘা জমিতে আদর্শ পদ্ধতিতে অমৃত সাগর কলার চারা রোপন করা হয়েছে। সঠিকভাবে প্রজেক্টের যতœ নিতে পারলে এখান থেকে কলার চারা জেলার সকল কৃষকের মাঝে বিতরণ করা যাবে। এতে করে কৃষকরা হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। জেলায় আবারো কলার অধিক চাষাবাদ শুর হবে। মাটির ব্যবস্থাপনা ভাল থাকলে অমৃত সাগর কলার ঐতিহ্য আবার উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলায় কৃষি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও কৃষকদের অমৃত কলা চাষের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :