অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সমতলের আদিবাসীদের প্রত্যাশা ও ৬ নভেম্বর ২০১৬ গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মে তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার ও পৈত্রিক সম্পত্তি ফেরতের দাবিতে "সংবাদ সম্মেলন" অনুষ্ঠিত হবে।জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির আয়োজনে বুধবার (৬ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের হল রুমে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি সূভাষ চন্দ্র হেমব্রম লিখিত বক্তব্য রাখেন। তিনি এসময় আদিবাসীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সমতলে তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাঁওসহ প্রায় ৩৮টি জাতিসত্তার প্রায় ২০ লাখেরও বেশী আদিবাসী বসবাস করেন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরা অংশগ্রহণ করে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। জীবন দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর নিজ দেশে আদিবাসীরা দেখলো তাদের বাড়িঘর-ভিটেমাটি সব দখল হয়ে গেছে। অনেকেই বেদখল হওয়া জমি আজও ফেরত পায়নি। বর্তমান সময়েও আদিবাসীদের জীবন সঙ্কটপূর্ণ হয়ে পড়েছে এবং তাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে চরম অবনতি ঘটছে। আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা দিনদিন আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময় আদিবাসীদের উপর অত্যাচার, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, জাল দলিল, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, মিথ্যা মামলা, লুটপাট, জবর দখল, দেশ ত্যাগে বাধ্যসহ নানা ধরনের নির্যাতন নিপীড়ণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আদিবাসীরা এখন নিজ দেশে পরবাসীর ন্যায় জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের উপর নিপীড়ণ, ভূমি দখল, উচ্ছেদ, ধর্ষণ, হত্যার মামলায় থানা পুলিশ, স্থানীয় অসৎ জনপ্রতিনিধি ও ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভূমিদস্যু ও সন্ত্রাসীদের পক্ষাবলম্বন করে সহায়তা করে আসছে। ফলে আদিবাসীরা আরও অসহায় হয়ে পড়ছে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর রংপুর সুগার মিল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা সাঁওতালদের উচ্ছেদ করতে গেলে স্থানীয় প্রভাবশালী, পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতালদের দফায় দফায় সংঘর্ষে ৩০ জন সাঁওতাল আহত হয়। তাদের মধ্যে মঙ্গল মার্ডি, রমেশ টুডু ও শ্যামল হেমব্রম মারা যান। কিন্তু গত আট বছরেও গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মেও তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার হয়নি।
অনেক সাঁওতাল এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছে। অতীতের অনেক সরকারের পক্ষ থেকে নানা আশ্বাসের বাণী শোনালেও তার কোনোটিই এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আমরা অতিদ্রুত তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার ও আসামিদের গ্রেপ্তার করে আইনানুগ শাস্তি এবং সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট, গুলিতে আহত ও অগ্নিসংযোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সাঁওতালদের ক্ষতিপূরণ ও সাঁওতালদের তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড নির্মাণ বন্ধের দাবি জানান।
দাবিসমূহ হচ্ছে :
১. আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান ;
২. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করা;
৩. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সমতল তথা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ থেকে আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা ;
৪.গাইবান্দা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মের ১৮৪২.৩০ একর সম্পত্তি প্রকৃত জমি মালিকদের ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তিন ফসলি জমিতে ইপিজেড (ঊচত) স্থাপনের পরিকল্পনা বন্ধ করা ; এবং গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে পুলিশের গুলিতে নিহত তিন সাঁওতাল হত্যার বিচার এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানসহ ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সেই সাথে আদিবাসীদের ওপর থেকে সকল প্রকার মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা;
৫. দিনাজপুর ও নওগাঁয় প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমীতে দ্রুত জনবল নিয়োগ করা এবং রাজশাহী বিভাগীয় আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমীর উপ-পরিচালক পদে আদিবাসীদের মধ্য থেকে নিয়োগ করতে হবে;
৬. আদিবাসীদের উপর চলমান অত্যাচার, হুমকি, ঘরবাড়ি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ, মিথ্যা মামলা, ভূমি দখল বন্ধ প্রয়োজনীয় আইনী পদক্ষেপ নিতে হবে ও আদিবাসী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে করা;
৭. আদিবাসী ছাত্র-যুবদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণসহ আদিবাসীদের জন্য উচ্চ শিক্ষা ও প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেনীসহ সকল সরকারি চাকুরিতে ৫% কোটা সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করা ;
৮. সকল আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতসহ আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কমপক্ষে একজন করে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ করা;
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বগুড়া জেলা সভাপতি সন্তোষ সিং বাবু, বগুড়া সাবেক সভাপতি যোগেশ সিং, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অনিল গজাড়, সাধারণ সম্পাদক শীত কুমার উরাও, বগুড়া জেলা সাধারণ সম্পাদক সাগর কুমার সিং প্রমূখ।
একুশে সংবাদ/ এস কে
আপনার মতামত লিখুন :