নানা সমস্যায় জর্জরিত ঐতিহ্যবাহী ময়মনসিংহের গৌরীপুর সরকারি কলেজের। ১ আগস্ট এ কলেজটির ছিলো ৬০তম বর্ষপূর্তি। ১৯৬৪ সালের ১ আগস্ট এ বিদ্যাপীঠ যাত্রা শুরু করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে এখন অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমাণের। এই অগ্রযাত্রার মূলভিত্তি আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগা প্রযুক্তি) বিভাগ। কলেজর এ বিভাগের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭ হাজার ৫শ ৫২জন। পাঠদানে রয়েছেন মাত্র একজন প্রভাষক! ৭টি কম্পিউটার নিয়ে যাত্রা শুরু হয় ডিজিটাল ল্যাবের।
বর্তমানে ৩টি কম্পিউটার নষ্ট। ঐতিহ্যবাহী এ সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষার্থী ৮ হাজার ১৫২জন। তাদের পাঠদানে রয়েছেন মাত্র ২জন শিক্ষক। ৩ হাজার ৭শ ১২জন ছাত্রীর জন্যে নেই কোনো ছাত্রীনিবাস। ৪ হাজার ৪শ ৪০ জন ছাত্রের মধ্যে ভাগ্যবান ৩০জনের ঠাঁই মিলেছে ভাঙ্গা-স্যাঁতস্যাতে, নড়বড়ে ডিগ্রী হোস্টেলে। ক্লাসরুম সংকট, আবাসন অপ্রতুল ও শিক্ষক শূণ্যতাসহ নানা সমস্যা জর্জরিত এ বিদ্যাপীঠ।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আবদুল হামিদ জানান, অনার্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের ক্লাস সংকটের জন্য ৬ তলা ভবন নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পত্র দিয়েছি। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে এক হাজার আসন বিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়াম, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, গ্রন্থাগার নির্মাণ, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ছাত্রী হোস্টেল ও শিক্ষকদের জন্য একটি কোয়াটার নির্মাণের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, জরুরী ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একটি মুক্তমঞ্চ, ছাত্রীদের হাইজিং কক্ষ, মাতৃদুগ্ধ কর্ণার, মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করার জন্য কাউন্সিলিং বিভাগের একটি ভবন প্রয়োজন।
অপরদিকে এ কলেজে ৯১ সনের ৩জুন নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক হিসেবে যোগদান করেন সুভাষ চন্দ্র ভৌমিক। তার চাকুরী আজও স্থায়ীকরণ হয়নি। স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে মাস্টার রুলে যা পান তা দিয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি। সুভাষের মত আজও চাকুরী স্থায়ীকরণ হয়নি অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর কাজী মো. সেতাউল হাসান, ইলেক্ট্রিশিয়ান মো. রুকন মিয়া, কম্পিউটার ল্যাব সহকারী মাকসুদুল হক, সেমিনার সহকারী মোকরামিন, বুক সর্টার তন্বী রানী সরকার, বাবুর্চি নয়ন তারা, নৈশ প্রহরী নিতাই চন্দ্র সরকার, মো. উমর ফারুক, এমএলএসএস (অফিস সহায়ক) মো. আব্দুস সাত্তার, শাহ তাজ উদ্দিন আহমেদ, মোসা. জাহেদা আক্তার, মো. শফিকুল হাসান, মো. খোরশেদ আলম, মো. স্বপন মিয়া, মো. আব্দুর রহিম, জহিরুল ইসলাম সুমন, মো. হুমায়ূন কবির, মো. বাকী বিল্লাহ, মো. আব্দুল মান্নান, মো. রোয়েল মিয়া, পান্না আক্তার, ঝাড়ুদার মনোয়ারা খাতুন।
এদিকে এই কলেজর দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আজিজুল হক হারুন দেশের জন্য ৬৯’রের গণঅভ্যূত্থানে শহীদ হন। যার আজও মিলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এ কলেজ ক্যাম্পাসটি ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ শিবির হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সে সময এ কলেজের অর্ধশত শিক্ষার্থী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এবার কোটা আন্দোলনেও মিছিল-মিটিংয়ে পিছিয়ে ছিল না এ কলেজের শিক্ষার্থীরা।
অপরদিকে ছাত্র নেতৃত্বের বিকাশ, যোগ্য নেতা তৈরির কারখানা আর ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম ছিলো ছাত্র সংসদ। শুধু কলেজের নয়, গৌরীপুরের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায়ও ভূমিকা রেখে আসছিলো এই ছাত্র সংসদ। যার নির্বাচন ২৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের কলেজ বার্ষিকী সম্পাদক মো. ফারুকুল ইসলাম বলেন, এ কলেজে প্রতিবছর দু’টি বা তিনটি ছাত্র সংসদ প্যানেলের মাধ্যমে শতাধিক নেতার জন্ম হতো।
এই কলেজের ছাত্র নেতারাই বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আসনে দায়িত্ব পালন করছেন। আজকে ছাত্র সংসদদের নির্বাচন না হওয়াটা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করছেন বিজ্ঞজনেরা।
এক তথ্যে জানাগেছে এ কলেজের ১৯৬৫-৬৬সনে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলে কটিয়াদির মো. কামরুল ইসলাম ভিপি (সহ-সভাপতি) ও কিশোরগঞ্জের মো. সাহেদ আলী ফকির জিএস (সাধারণ সম্পাদক) নির্বাচিত হন।
এরপরে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন পর্যায়ক্রমে ৬৬-৬৭সনে মোতালেব চৌধুরী, কাজী আশরাফ উদ্দিন, ৬৭-৬৮সনে নাট্যকার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই, বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, ৬৮-৬৯সনে ছাত্রলীগের বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক, ইকবাল হাসান (ছাত্র ইউনিয়ন), ৬৯-৭০সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে তারাকান্দার মো. কাজীম উদ্দিন, জহির বেগ, ৭২-৭৩সনে ছাত্র ইউনিয়ন প্যানেলে মো. আব্দুস সাত্তার, মো. নাজমূল হক, ৭৩-৭৪সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম, মো. সিদ্দিকুর রহমান, ৭৯-৮০সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম, খন্দকার জহিরুল ইসলাম, ৮১-৮২সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে দেওয়ান কাঞ্চন খান, মো. ইদ্রিস আলী, ৮৩-৮৪সনে ছাত্রদল প্যানেলে ইউনুছ আলী ফকির, হারুন অর রশিদ কুলি খান, ৮৪-৮৫সনে ছাত্র সমাজ প্যানেলে বেগ ফারুক আহাম্মদ, মুর্শেদুজ্জামান আনার, ৮৫-৮৬সনে আব্দুল আউয়াল (ছাত্র সমাজ), সৈয়দ রফিকুল ইসলাম (বাকশাল, জাতীয় ছাত্রলীগ), ৮৬সনে মুর্শেদুজ্জামান আনার (জাতীয় ছাত্র সমাজ), শামসুল হক শামছু (ছাত্রদল), ৮৯-৯০সনে শামসুল হক শামছু (ছাত্রদল), মোখলেছুর রহমান বাবুল (ছাত্র ঐক্য), ৯০-৯১সনে শামসুল হক শামছু (ছাত্রদল), মো. মাহফুজ উল্লাহ (ছাত্রলীগ), ৯৩-৯৪সনে মো. মাহফুজ উল্লাহ (ছাত্রলীগ), আলী আকবর আনিছ (ছাত্রদল), ৯৫-৯৬সনে ছাত্রদল প্যানেলে ফারুক আহমেদ, ইকবাল হোসেন, ৯৬-৯৭সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে মো. হাবিবুল্লাহ, আনোয়ার হোসেন টিটু, ৯৭-৯৮সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে মাহবুবুর রহমান শাহীন, মুজিবুর রহমান, ২০০০-০১সনে ছাত্রলীগ প্যানেলে শহিদুল ইসলাম অন্তর ভিপি ও মাজহারুল ইসলাম টুটুল জিএস নির্বাচিত হন।
এদিকে ছাত্রী নিবাস না থাকায় শিক্ষার্থীদের ১০গুণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতা ও যৌন হয়রানির শংকায় দিন কাটে এ কলেজের হাজারো নারী শিক্ষার্থীদের । কলেজটিতে একাদশ শ্রেণিতে ৫৭৫জন ছাত্রী, দ্বাদশ শ্রেণিতে ছাত্রী ৫৫২জন, স্নাতক (পাস) কোর্সে ছাত্রী ১হাজার ৩০১জন, স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ছাত্রী ১হাজার ২৮৪জন সর্বমোট ৩হাজার ৭১২জন ছাত্রী অধ্যায়ন করছে। এ ছাত্রীরা হোস্টেলের কোন সুবিধাই পাচ্ছেন না। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সুবিধাসহ বাসা ভাড়া পেতে অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
অপরদিকে বৃষ্টিতে ভিজে শিক্ষা উপকরণ, রাত জেগে জরাজীর্ণ একটি হোস্টেলে শিক্ষাজীবন অতিক্রমের সুযোগ পাচ্ছে মাত্র ৩০জন ছাত্র। প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার ছাত্রছাত্রী হোস্টেলে সিটের থাকার আবেদন করেও পাচ্ছেন না সিট বরাদ্দ।
প্রস্তাবিত বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ছাত্রী নিবাসের নির্মান কার্যক্রম সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ ক্যাপ্টেন (অব.) মজিবুর রহমান ফকির এম.পি’র মৃত্যুতে মঞ্জুরী ফাইলের অগ্রগতি কার্যক্রমও স্থগিত হয়ে যায়। তৃতীয় তলা বিশিষ্ট এ ছাত্রী নিবাসটি নির্মিত হলে ১০০জন ছাত্রী সেখানে লেখাপড়ার সুযোগ ছিলো বলে জানান কলেজ কর্তৃপক্ষ। ২০১৪সালে ডিজাইন, প্রাক্কলিক ব্যয় উল্লেখ করে ১০০জনের আরেকটি ছাত্রাবাসের আবেদন প্রেরণ করেন তৎকালিন অধ্যক্ষ প্রফেসর আল হেলাল ভূঞা। যা আজও আলোর মুখ দেখেনি। সরকারি কলেজের চারপাশে বছরের পর বছর সাইনবোর্ড ঝুলছে, মিলছে না নতুন ভবন!
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :