AB Bank
  • ঢাকা
  • সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩০

সরকার নিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল

Ekushey Sangbad QR Code
BBS Cables
Janata Bank
  1. জাতীয়
  2. রাজনীতি
  3. সারাবাংলা
  4. আন্তর্জাতিক
  5. অর্থ-বাণিজ্য
  6. খেলাধুলা
  7. বিনোদন
  8. শিক্ষা
  9. তথ্য-প্রযুক্তি
  10. অপরাধ
  11. প্রবাস
  12. রাজধানী

গৃহবধূ থেকে সফল কৃষি উদ্যোক্তা শ্রীপুরের মর্জিনা


Ekushey Sangbad
টি আই সানি, শ্রীপুর, গাজীপুর
০৫:১০ পিএম, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
গৃহবধূ থেকে সফল কৃষি উদ্যোক্তা শ্রীপুরের মর্জিনা

বসত বাড়ীর উত্তর পাশে ৫ বিঘা জমির উপর খনন করা অন্যের পুকুর। পুকুরের পানিতে মাছের লুকোচুরি খেলা। পুকুরের চার পাশে সারি সারি লাউয়ের মাচায় ঝুলছে শীতকালীন সবজি সবুজ ও সাদা লাউ। স্বামী, চার মেয়ে, এক ছেলে ও শাশুড়িকে নিয়ে তিনিসহ (মর্জিনা) আট সদস্যের সংসারের সব কাজ এক হাতে সামলাচ্ছেন গৃহবধূ মর্জিনা বেগম। গৃহবধূ থেকে সংসারের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাওয়া মর্জিনা এখন সফল কৃষি উদ্যোক্তা। ৩৫ বছর বয়সী এই গৃহবধূ কীভাবে হলেন কৃষি উদ্যোক্তা? শনিবার (০৭ ডিসেম্বর) গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের টেংরা (উত্তরপাড়া) গ্রামে তাঁর ৬ বিঘা লাউ ক্ষেতে গেলে শোনান সাফল্যের গল্প।

২০০৪ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের আগের দিন পাশের টেংরা গ্রামের স্যানেটারী (প্লাম্বার) মিস্ত্রী আকতারুজ্জামানের সাথে বিয়ে হয় মর্জিনা বেগমের। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় পড়ালেখা বেশি দূর এগোয়নি। ২০০৫ সালে স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন মর্জিনা। মর্জিনা-আকতারুজ্জামানের সংসারে চার মেয়ে সুমাইয়া জীম, সিনথিয়া আক্তার, সুরাইয়া আক্তার, সামিয়া আক্তার এবং শিশু ছেলে মেহেদী হাসান ইসরাক রয়েছে। এর মধ্যে বড় মেয়ে সুমাইয়া এইচএসএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, সিনথিয়া নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী, সুরাইয়া ক্লাশ থ্রীর শিক্ষার্থী, সামিয়া প্রথম শ্রেণিতে এবং ছোট ছেলে ইসরাক। সংসারের সব সামলেও নিজে কিছু করার ইচ্ছা ছিল মর্জিনা বেগমের। তাঁকে সহযোগিতার হাত বাড়ান স্বামী।



২০০২২ সালের বাড়ীর পাশে খোলা জায়গায় খাওয়ার জন্য ডায়না জাতের লাউ বীজ বপন করি। ওই বছরে ভালো ফলন হওয়ায় পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশীদের বিলিয়ে স্থানীয় টেংরা বাজারেও বিক্রি করি। তখন চিন্তা আসলো লাউ লাভজনক সবজি। স্বামীর সাথে পরামর্শ করি বড় পরিসরে লাউ চাষ করার। তিনি সম্মতি দিলে ২০২৩ সালে দেড় বিঘা জমিতে লাউ চাষ করি। চলতি বছর অন্যের ৫ বিঘা জমির উপর খনন করা পুকুর স্বামীর কাছ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও তার  নিজের নাক ফুল, কানের দুল, গলার চেইন বিক্রি করে পান ৫০ হাজার টাকা। মোট ২ লাখ টাকায় ভাড়া নিয়ে পুকুরের চারপাশে ১৩০টি থলায় লাউ চারা রোপন করেন। বাড়ীর উত্তর পশ্চিম পাশে নিজের দেড় বিঘা জমিতেও ১০৮টি থলায় লাউয়ের চারা রোপন করি। মোট সাড়ে ৬ বিঘা জমিতে মেটাল, লাল তীর ডায়না এবং পল্লবী এই তিন জাতের ২৩৬টি লাউয়ের থলায় রোপনকৃত লাউ ক্ষেতে  প্রচুর পরিমাণে লাউ আসছে।

প্রাথমিকভাবে তিনি পুকুরপাড়ে ২০০টি লাল তীর বীজ বপন করেন। এর মধ্যে ১৮০টি গাছে ফলন ভালো হয়। এখন তার বাগানে ৫০০০-৬০০০ লাউ ঝুলে আছে। পাইকাররা তার ক্ষেতে এসে লাউ নিজ হাতে কেটে নেয়। প্রতি লাউ প্রকার ভেদে ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।

মর্জিনা বেগম আরো জানান, স্বামী কাজে বেরিয়ে গেলে অলসভাবে বসে থাকা ভালো লাগত না। ইচ্ছে জাগে বসতবাড়ির আশপাশে শাকসবজি ও ফলমূলের বাগান গড়ে তোলার। সে চিন্তা থেকে বাড়ির আঙ্গিনা ও খোলা জায়গায় চাষ শুরু করি। পুকুর ভাড়া নিয়ে সেই পুকুর পাড়ে লাউ চাষ করে সফল হয়েছেন গৃহবধূ মর্জিনা। লাউ বিক্রি করে বাড়তি আয় হতে থাকে। সংসার খরচের বোঝা কমে যাওয়ায় প্রথম থেকেই স্বামী কোনো আপত্তি করেননি। বৃষ্টির কারণে কিছুটা ক্ষতি হলেও মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় প্রচুর পরিমাণে লাউ ধরেছে গাছগুলোতে। সাড়ে ৬ বিঘা জমিতে লাউ গাছের মাচা তৈরিতে বাঁশ, খোটা, থলা তৈরি করা সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা। এ পর্যন্ত ৪ লাখ টাকার লাউ বিক্রি করেছেন। চলতি মৌসুমে তিনি ১৫ লাখ টাকার লাউ বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন। লাউ চাষে সাফলতা দেখিয়েছেন গৃহবধূ মর্জিনা বেগম। ইতোমধ্যে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টেংরা এলাকায় সুনাম অর্জন করেছেন। গৃহবধূ মর্জিনার সফলতা দেখে এলাকার অনেকেই এখন লাউ চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাণিজ্যিকভাবে লাউ চাষের চিন্তা করছেন অনেকেই।

মর্জিনার লাউ ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায় তার সাথে স্বামী আকতারুজ্জামান, দুই মেয়ে সুমাইয়া জীম ও সিনথিয়া আক্তার লাউ বাগানে কাজ করছেন। কীটনাশকের ব্যবহার এড়াতে আক্রান্ত লাউ এবং মরে যাওয়া লাউ পাতা কেটে ফেলে দিতে দেখা যাচ্ছে। কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে শুধু জৈব সার দেন লাউ গাছে। বিষমুক্ত লাউ চাষ করেন। স্থানীয় গরুর খামার থেকে গোবরের সার সংগ্রহ করে ব্যবহার করেন লাউ গাছে।

মর্জিনার মেঝো মেয়ে সিনথিয়া বলেন, আমার আম্মু প্রথমে ছোট করে একটা লাউ ক্ষেত করেছিল। ওই ক্ষেত থেকে ভালো লাভ হয়। পরে আম্মু আরো বড় পরিসরে লাউ চাষ করে। ওই ক্ষেতে আমি এবং আমার আপু সুমাইয়া স্কুল থেকে এস আব্বা ও আম্মুকে সগযোগীতা করি। লাউ ক্ষেতে আম্মু যখন লাউ কাটে তখন আমরা দুই বোন লাউ জড়ো করে দেই। দিন দিন আম্মুর লাউ ক্ষেত থেকে অনেক লাভ আসছে। আমরা এখন খুব খুশি।

স্থানীয় লাউ ব্যবসায়ী জসীম উদ্দিন বলেন, আমি চলতি মৌসুমে মর্জিনা আপার ক্ষেত থেকে পাইকারি দামে লাউ কিনে নেই। প্রকারভেদে লাউ ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত দামে লাউ কিনি। ছাতির বাজার, লোহাই বাজার, শ্রীপুর বাজারে লাউ বিক্রি করি। ক্রেতারা লাউয়ের জন্য আমাকে খোাঁজ করে। মর্জিনার আপার ক্ষেতের লাউ খুবই ভালো। আমি এ পর্যন্ত উনার কাছ থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকার লাউ কিনে নিয়ে বাজারে খুচরা বিক্রি করেছি।

প্রতিবেশী গৃহবধূ রেহেনা পারভীন বলেন, মর্জিনা ভাবির লাউ বাগানে আমি বিভিন্ন সময় কাজে সহযোগীতা করি। বিষমুক্ত লাউ খুব সুস্বাদু। আমি ভাবির লাউ ক্ষেত দেখে চিন্তা করছিআগামীতে বাড়ীর আঙ্গিনায় লাউ চাষ করবো। অলপ খরচে লাউ চাষ করে ভালো উপার্জন করা সম্ভব।

মর্জিনার স্বামী আকতারুজ্জামান বলেন, আমি ইলেক্ট্রিক এবং প্লাম্বার মিস্ত্রী। গত দুই বছর আগে কালিয়াকৈরের ফুলবাড়ীয়া এলাকা থেকে লাউয়ের চারা সংগ্রহের জন্য যাই। সেখান থেকে নার্সারি মালিক আমাকে ২০ টি চারা দিলে নিজে খাওয়ার জন্য বাড়ীর চারপাশে রোপন করি। আমার স্ত্রী গাছগুলো খুব যতœ করে বড় করে। গাছগুলোতে অনেক লাউ আসে। নিজে খেয়ে প্রতিবেশীদেরকে দিয়ে বাজারে বিক্রিও করেছি। তখন থেকেই মনে হয়েছে লাউ চাষ লাভজনক সবজি। গত বছর তিন বিঘা জমিতে লাউ চাষ করে সকল খরচ বাদ দিয়ে ১০ লাখ টাকা ক্যাশ থাকে। মর্জিনার পরিশ্রমই আমার সংসারের ভাগ্য বদলেছে। চলতি বছরে প্রথম ধাপেই ৪ লাখ টাকার লাউ বিক্রি করেছি। আরো তিন থেকে চারবার লাউ নামাতে পারব। সে থেকে ১৫ লাখ টাকা লাউ বিক্রির আশা করেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, সপ্তাহের সাতদিনই তিনি আশপাশের বিভিন্ন বাজারে লাউ বিক্রি করেন। গাছ থেকে বেপারীরা লাউ নিয়ে গড়ে ৭০ টাকা পর্যন্ত দাম দেই। আমি নিজে বাজারে নিয়ে গেলে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। প্রতি সপ্তাহে আমি বাজারে ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকার মতো লাউ বিক্রি করে থাকি।

এলাকার মা-বোনদের উদ্দেশ্যে লাউ চাষী মর্জিনা বলেন, বাড়ীর আঙ্গিনা ও আশপাশের পতিত জমিতে লাউ চাষ করেন। লাউ চাষ খুব লাভজনক সবজি। এতে বেশি খরচ হয় না। জৈব সার দিয়ে লাউ চাষ করা যায়। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করলেও চলে। নিজের পুষ্টি ও চাহিদা মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করে লাভবান হতে পারবেন।

বর্গা নেওয়া পুকুরে মর্জিনা মাছও চাষ শুরু করেছেন। মাছ বিক্রি করে আয়েরও পরিকল্পনা রয়েছে মর্জিনার। স্থানীয় কৃষি অফিস থেকে মর্জিনাকে ভালো পরামর্শ দিয়েছে। সার ওষুধ কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে সে বিষয়ে স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সবসময় যোগাযোগ করে। পুকুরের মাছ এবং লাউ বিক্রির ল্যাভ্যাংশ দিয়ে আরও ভালো কিছু করার পরিকল্পনা আছে।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমাইয়া সুলতানা বন্যা বলেন, শীতকালে লাউ অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সবজি। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১৭৫ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ আবাদ হয়েছে। লাউ শাক আবাদ হয়েছে ৫৫ হেক্টর জমিতে। কৃষকেরা ওইসব জমির উৎপাদিত লাউ প্রায় ৮ কোটি টাকা বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে কৃষকদের লাউ চাষে বিভিন্নভাবে পরামর্শ ও উৎসাহ দিয়ে লাউ চাষে উদ্ভোদ্ধ করা হয়। টেংরা গ্রামের নারী কৃষি উদ্যোক্তা লাউ চাষ করে সফলতা অর্জন করেছে। শ্রীপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি লাউ চাষ হয় প্রহ্লাদপুর ইউনিয়নে। এরপর বরমী, কাওরাইদ এবং মাওনা ইউনিয়ন এলাকায়।

 

একুশে সংবাদ/বিএইচ

Link copied!