উপকূলীয় এলাকায় জন্ম, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এর তাণ্ডব দেখে দেখে বেড়ে উঠেছেন। উপকূলের জনজীবন, সংগ্রাম তার মনে দাগ কাটে খুব। নিজের জন্মস্থান অবহেলিত এই উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য বরাবরই কিছু করতে চেয়েছেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন কিছু একটা করার।
শুধু স্বপ্ন দেখাতেই সীমিত ছিলনা, উদ্যোগী হয়েছেন তিনি; হয়ে উঠেছেন শিশু জলবায়ু যোদ্ধা। “লিটল সিটিজেন্স” নামের একটি শিশু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ’ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।
শুরুতে মোবাইলের মাধ্যমে ছবি, ভিডিও ও লেখালেখিতে তুলে ধরতেন উপকূলের চিত্র। ইউনিসেফ এর শিশু সাংবাদিকতার সাইট হ্যালোতে প্রকাশ হত সেসব লেখা। উপকূলের অবস্থা তুলে ধরে সবাইকে সচেতন করার ব্রত নেন সানজিদুল। তার এ কাজ দেখে কয়েকজন বন্ধু এবং কয়েকটি এনজিও তার পাশে এসে দাঁড়ায়।
প্রত্যন্ত গ্রাম, চরাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে মানুষের সাথে মিশেছেন, তাদের সমস্যা গুলো বুঝতে চেয়েছেন, তা সমাধানে কাজও করেছেন সানজিদুল। স্বল্পআয়ের মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চিতে মডেল পুষ্টিবাগান নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। শিশু কিশোরদের মধ্যে পড়াশোনার অভ্যাস বাড়াতে তৈরি করেছেন কিশোর লাইব্রেরী। নিয়মিত উঠান বৈঠক, স্কুল ভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রজনন স্বাস্থ্য, শিশু সুরক্ষা নিয়ে সচেতন করেছেন কিশোর-কিশোরী ও তাদের অভিভাবকদের।
করোনার মহামারীর সময়েও থেমে থাকেনি তার কাজ। মানুষকে সচেতন করতে সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করেছেন উপকূলের মানুষের মধ্যে। এছাড়াও ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করে ফেস শিল্ড, মাস্ক ও হাতে তৈরি হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে বিতরন করেছেন তিনি ও তার টিম লিটল সিটিজেন্স।
সানজিদুল একসময় তার এলাকার নির্বাচিত শিশু এমপি ছিলেন। জাতীয় সংসদ এর পার্লামেন্টস মেম্বারস ক্লাবে আয়োজিত “বাংলাদেশ জেনারেশন পার্লামেন্ট” এর ১ম জাতীয় অধিবেশনে ভোলা-৪ আসনের প্রতিনিধিত্বও করেছেন তিনি। ইউনিসেফ এর কিশোর কিশোরী ক্লাবেও যুক্ত ছিলেন, বিভিন্ন সভা সেমিনারে সুযোগ পেলে উপকূলের শিশু কিশোরের কথা বলতেন।
২০২১ সালে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে “স্যার ফজলে হাসান আবেদ আশোকা ইয়াং চেইঞ্জমেকার” নির্বাচিত হন।বর্তমানে তার বয়স ১৮ পেরিয়েছে, কিন্তু এখনো সবার কাছে সেই “লিটল সিটিজেন্স” নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি।
সানজিদুল শুধু উপকূলবাসীর জন্য কাজ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন লেখাপড়া, দেখিয়েছেন মেধার প্রতিফলন। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার চর-মাদ্রাজ ইউনিয়নের চর-আফজাল গ্রামে বাড়ি তার। স্থানীয় চরমাদ্রাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, কেরামতগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নিম্ম মাধ্যমিক, চরফ্যাশন ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০১৯ সনে এসএসসি ও চরফ্যাশন সরকারি কলেজ থেকে ২০২১ সনে এইচএসসি পাশ করেন।এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় বরিশাল বোর্ড এর অধীনে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ন হয় সে।
এত কিছুতে যুক্ত থেকেও এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ন হয়েছেন। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে শের এ বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ এগ্রিকালচার ফ্যাকাল্টি তে অধ্যয়নরত অবস্থায় মেরিন একাডেমিতে ভর্তির সুযোগ পান। বর্তমানে সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে প্রি সী ক্যাডেট হিসেবে পড়াশোনা করছেন।
ছোটবেলা থেকে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাসহ পরিবারের নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। তবুও দমে যায়নি তিনি। পড়ালেখায় মেধাবী হওয়ায় শিক্ষকদের আলাদা দৃষ্টি ছিল তার উপর। পড়াশোনা ও বেড়ে উঠায় সবচেয়ে বেশি অবদান তার মায়ের। একটা সময় স্বচ্ছল পরিবার থাকলেও বাবার ব্যবসায় লোকসানের মুখে সংসারের হাল ধরে তার মা। স্বল্প বেতনের চাকরির সাথে সেলাই মেশিন, হাস মুরগি পালন করে আয় থেকে এতদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করিয়েছে সানজিদুলকে।
অদম্য ইচ্ছা থাকলে সবকিছু না হলেও অনেক কিছু যে করা যায়, প্রতিনিয়ত তার প্রমাণ রেখে চলেছেন সদ্য যৌবনে পা রাখা এই তরুণ।
সানজিদুল এর আগামীর ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, “একা কখনোই এতদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলনা। আমাদের টিমের সবার অবদান রয়েছে। বয়সে অনেক ছোট ছিলাম, মাথাভর্তি প্লান ছিল অনেক, কিন্তু সব গুলো তো বাস্তবায়ন করতে পারিনাই। এখনো সেসব ছোট ছোট আইডিয়াগুলো নিয়ে ভাবি এবং এগুলো নিয়েই কাজ করতে চাই। যদিও লিটল সিটিজেন্স এর বয়স পার করে ফেলেছি। কিন্তু সবার কাছে লিটল সিটিজেন্স হয়েই থাকতে চাই সবসময়।
তিনি আরো বলেন,আমার ইচ্ছা ছিল ব্যতিক্রমী কিছু করার সেজন্য পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময়টা সংগঠনে দিতাম। সবাই অনেক বকাবকি করত, পড়াশোনা হবেনা, এগুলো করে লাভ নাই। আরো কত কি? কিন্তু কোনো কথা কানে নেইনি। যে যাই বলুক, থেমে থাকা যাবে না। পথ চলতে গেলে হোঁচট তো খেতেই হবে। হোঁচট খেয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কারণ জীবনে সফলতার কোনো শেষ নেই।
একুশে সংবাদ/আ.য
আপনার মতামত লিখুন :