একটি ছোট ঘরে ছয়জন মানুষের ঠাঁই। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পেশার বেড়াজালে আটকে থাকা এক পরিবার। চরম দারিদ্র্য, ঘৃণা, বৈষম্যের শেকল। কিন্তু এসব কিছুই থামাতে পারেনি শীবা বাসফোরকে। সমাজের চোখে অবহেলিত এক জনগোষ্ঠীর সন্তান হয়েও তিনি প্রমাণ করেছেন- ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে সব কিছু সম্ভব।
রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ী ইউনিয়নের হরিজন পল্লিতে মৃত বাবুলালা বাসফোর ও মৃত সরস্বতী বাসফোরের ঘরে জন্ম নেওয়া শীবা বাসফোরের কথা। তার বাবা ২০১৬ সালে এবং মা ২০০৮ সালে প্রয়াত হণ। পরিবারের সবাই পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কারও কখনো স্কুল-কলেজে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। শীবা ছোটবেলায় বাজারের ড্রেন পরিষ্কার করা, মানুষের বাড়িতে কাজ করা, হাটবাজার ঝাড়ু দেওয়া - এসব করেই দিন কাটাতেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি বই কিনতেন, পড়াশোনার খরচ চালাতেন। হরিজন সম্প্রদায়ের ছেলে হওয়ায় অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে স্কুলে যেতে হতো। তারা যেন আলাদা এক জাতি! তবু তিনি গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের সাহায্যে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানেই থাকা-খাওয়া ও পড়ার সব কিছুর সুযোগ মিলে। এসবই ছিল শীবার ছোটবেলার বাস্তবতা।
এরপর ২০২০ সালে চীনের ইয়াংজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে ভর্তি হন শীবা। করোনার কারণে প্রথম দুই বছর বাংলাদেশে থেকেই অনলাইনে ক্লাস করতে হয়। ২০২৩ সালে তিনি চীনে যান এবং সফলভাবে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করে এ বছরে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে ফেরেন শীবা।
সমাজের চোখে অবহেলিত এক জনগোষ্ঠীর সন্তান হয়েও তিনি প্রমাণ করেছেন, ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
শীবা বাসফোর বলেন, ‘আমি যখন স্কুলে ভর্তি হতে চাইলাম, তখন সবাই বললো, ‘তোর কী দরকার পড়াশোনার? তোরা তো ঝাড়ুদারই থাকবি।’ তবু আমি হাল ছাড়িনি। অনেক দিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে, কখনো হোটেলের বাইরে মাটিতে বসে কাগজের পাতায় খেয়েছি। স্কুলে যখন সবাই ক্যান্টিনে গিয়ে খেতো, আমি দূর থেকে দেখতাম। কিন্তু আমি জানতাম, আমাকে বদলাতে হবে আমার ভাগ্য।’
জানা গেছে, শীবার পরিবারের কেউই নিজেদের বাড়ির মালিক নন। রংপুরের "ভিন্ন জগত" পার্কের ভেতরের একটি গোডাউন ঘরে তার বড় ভাই রতন বাসফোর ও তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান, ছোট ভাই রনজিত বাসফোর ও শীবা`সহ তাঁরা মোট ছয়জন থাকেন। তার বড় ভাই রতন বাসফোর অস্থায়ী স্কুল ক্লিনার, আর ভাবি ও ছোট ভাই পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এসবের মাঝেও শীবার ভাগ্যের চাকা ঘুরতেই অর্থের অভাবে আবার দুঃখের ভাজ পড়েছে।
শীবা বাসফোর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘মাস্টার্সের জন্য ইউরোপ ও আমেরিকায় আবেদন করেছেন। কিন্তু তার অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন। যদি সরকারি সহায়তা কিংবা কোনো ব্যাংক বা সংস্থা অথবা কোন বিত্তবান তাকে সহায়তা করে তাহলে আরও উচ্চশিক্ষা নিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য এবং দেশের জন্য কাজ করতে পারবেন।’
আরো বলেন "আমি গর্বিত যে আমি হরিজন। এই সমাজ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি চাই, আর কোনো শিশু যেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়।"
এই তরুণের গল্প শুধু তাঁর একার নয়-এটি সমাজের অবহেলিত মানুষের এক সংগ্রামী কাহিনি। শীবা বাসফোরের যাত্রা প্রমাণ করে, প্রতিকূলতা যত বড়ই হোক, ইচ্ছাশক্তির কাছে সব হার মানতে বাধ্য।
একুশে সংবাদ/বিএইচ
আপনার মতামত লিখুন :